ভুয়া বিল-ভাউচারে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। তার এসব অপকর্ম মেনে না নেওয়ায় শোকজ ও বিভাগীয় মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়াসহ শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা কর্মকর্তার এসব অপকর্মের প্রমাণসহ শিক্ষা অধিদপ্তরে অভিযোগে কেবল বদলি আদেশ দেওয়া হলেও নেওয়া হয়নি তেমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ফলে সম্প্রতি রাস্তায় নেমেও শিক্ষা কর্মকর্তার বিচার দাবি করেছেন শিক্ষকেরা।
নথি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২০ সালে যোগদানের পর থেকেই উপজেলার কিছু প্রাথমিক শিক্ষকদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন সাঁথিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। এরপর তাদের সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন সময় ভুয়া বিল-ভাউচারে সরকারি অর্থ লোপাটে জড়িয়ে পড়েন। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় গত ১৭ জুলাই হেলাল উদ্দিনকে সাঁথিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদ থেকে নাটোরের বড়াইগ্রামে বদলি করা হয়। কিন্তু নানা বাহানায় কর্মস্থল ছাড়েননি তিনি।
ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) কোর্স সম্পন্ন করেননি হেলাল উদ্দিন। তারপরও নিজ অনুগত উপজেলার জোড়গাছা ইউনাইটেড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলামের নামে গত ২১ জুলাই (৩৫১ নম্বর বিল-ভাউচারে) এ কোর্স বাবদ সাত লাখ ২ হাজার ৭৭৪ টাকার বিল অনুমোদন করেন। অভিযোগ রয়েছে, এ বিল নিজ নামে না উত্তোলন করে কৌশলে তার গড়া সিন্ডিকেট সদস্য শিক্ষক নজরুল ইসলামকে দিয়ে ২৪ জুলাই উত্তোলন করান।
‘শিক্ষকদের ভ্রমণ ভাতার কোনো বিল বিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে শিক্ষা অফিসে জমা দেওয়া হয়নি। সাধারণত একটি রেজিস্টার বইয়ে সই নিয়ে সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষা কর্মকর্তা ভুয়া ভাউচার করে এ বাবদ বছর বছর বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন। যা আমরা পরে জানতে পেরেছি।’
২০২১-২২ অর্থবছরে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯০০, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাখ ৯০ হাজার এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের ভ্রমণভাতা বাবদ উত্তোলন করা হয়েছে। এসব বিল ভাউচারে শিক্ষা অফিসার হেলাল উদ্দিনের সই রয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অভিযোগ, কয়েকজনকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তার কয়েকগুণ বেশি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তা।
চোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম বলেন, শিক্ষকদের ভ্রমণ ভাতার কোনো বিল বিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে শিক্ষা অফিসে জমা দেওয়া হয়নি। সাধারণত একটি রেজিস্টার বইয়ে সই নিয়ে সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। অথচ শিক্ষা কর্মকর্তা ভুয়া ভাউচার করে এ বাবদ বছর বছর বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন। যা আমরা পরে জানতে পেরেছি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা অফিসে দুটি মোটরসাইকেলের জন্য একই অর্থবছরে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে ভুয়া বিল ভাউচারে জ্বালানি ও মেরামত বাবদ বরাদ্দের চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। তদন্ত করলেই এসব বেরিয়ে আসবে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই বিগত সরকারের সময়ে উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শিশুদের পাঠের অনুপযোগী ও বিতর্কিত বই কিনতে বাধ্য করেন এই শিক্ষা অফিসার। ৫ আগস্টের পর প্রতি বিদ্যালয়ে তিন হাজার টাকা হিসেবে মোট পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার টাকার বই কিনতে বাধ্য করেন তিনি। এতে কিছু শিক্ষক আপত্তি জানিয়ে লিখিত নির্দেশনা দেওয়ার কথা বলেন। পরে তাদের বিদ্যালয় পরিদর্শন করে মিথ্যা অভিযোগে প্রথমে শোকজ ও সবশেষ বিভাগীয় মামলায় ওই শিক্ষকদের ফাঁসিয়ে দেন তিনি।
শিক্ষা অফিসার হেলাল উদ্দিন কিছু শিক্ষকদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট করে সব ধরনের অপকর্ম করছেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলতাব হোসেন।
‘সরকারি নির্দেশনা ছাড়াই বিগত সরকারের সময়ে উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে শিশুদের পাঠের অনুপযোগী ও বিতর্কিত বই কিনতে বাধ্য করেন এই শিক্ষা অফিসার। ৫ আগস্টের পর প্রতি বিদ্যালয়ে তিন হাজার টাকা হিসেবে মোট পাঁচ লাখ ৩৪ হাজার টাকার বই কিনতে বাধ্য করেন তিনি। এতে কিছু শিক্ষক আপত্তি জানিয়ে লিখিত নির্দেশনা দেওয়ার কথা বলেন। পরে তাদের বিদ্যালয় পরিদর্শন করে মিথ্যা অভিযোগে প্রথমে শোকজ ও সবশেষ বিভাগীয় মামলায় ওই শিক্ষকদের ফাঁসিয়ে দেন তিনি।’
তিনি বলেন, কেউ কিছু বললে তার ওপর শাস্তি নাযিল করেন তিনি। মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়ে তদন্ত করান, বিভাগীয় মামলাতেও ফাঁসিয়েছেন। একজন শিক্ষককে শিক্ষা অফিসে তার অনুগত শিক্ষকদের দিয়ে মারধরও করিয়েছেন। এতে আমাদের রুটি-রুজিতে টান পড়েছে। এসব নিয়ে ইউএনও, ডিসি এমনকি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছেও আমরা গিয়েছি। তার অপকর্মের সব প্রমাণসহ অভিযোগ জানিয়েছি। বাধ্য হয়ে রাস্তায়ও দাঁড়িয়েছি। শুধু বদলি নয়, আমরা এর বিচার চাই।
বিল উত্তোলনের কথা স্বীকার করে প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের টাকা অন্যখাতে চলে যাচ্ছিল। সরকারি টাকার মিসইউজ ঠেকাতে টাকাগুলো তুলে আবার সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছি। শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে যোগসাজশে টাকা লোপাটের অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
নজরুল ইসলামের বিলে সই দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন অভিযুক্ত শিক্ষা কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ওই বিলে আমি সই করিনি। এ বিল ওই শিক্ষক কোনোভাবেই পান না। কীভাবে বিলটি হয়েছে আমার জানা নেই।
হেলাল উদ্দিন আরও বলেন, বই কেনার ব্যাপারেও আমি কিছু জানি না। তৎকালীন ইউএনও ও শিক্ষকেরা মিলে বিদ্যালয়ে বই নিয়েছেন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমি এখানে দায়িত্ব পালন করছি। বিভিন্ন সময় তাদের অনৈতিক দাবি পূরণ না করায় কিছু শিক্ষক আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন।
এ বিষয়ে সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিজু তামান্না বলেন, শিক্ষকেরা বেশ কিছুদিন ধরেই শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা বলছিলেন। সম্প্রতি আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি আমার ঊর্ধ্বতনদের জানাবো। নির্দেশ পেলে শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করা হবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল কবীর বলেন, সাঁথিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে। ঢাকা থেকেও উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত করা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন : :