• ঢাকা
  • বুধবার, ০৬ আগস্ট, ২০২৫, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | নিজস্ব প্রতিবেদক আগস্ট ৫, ২০২৫, ১২:২৬ পিএম মাইলস্টোন ট্রাজেডি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে বিমান দুর্ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় দুই সপ্তাহ। তবুও মাইলস্টোন কলেজে শোকের আবহ কাটেনি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চোখে-মুখে এখনো ভয়-আতঙ্ক। গত রবিবার সীমিত আকারে ক্যাম্পাস খুললেও পাঠদান হয়নি। চলেছে দোয়া মাহফিল ও শিক্ষার্থীদের মানসিক পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে কাউন্সেলিং কার্যক্রম। এরপরও ছেলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় ওইদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মেয়ে শিক্ষার্থীরাই বেশি ট্রমার মধ্যে রয়েছে। 
সম্প্রতি কলেজটির অধ্যক্ষ মো. জিয়াউল আলম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া। আমরা চেষ্টা করছি কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়াতে।
তিনি জানান, ছাত্রীদের মধ্যে ট্রমার প্রভাব ছেলেদের তুলনায় বেশি দেখা যাচ্ছে। মেয়েদের জন্য আলাদা মনোযোগ দিয়ে কাউন্সেলিং চালানো হচ্ছে।
অধ্যক্ষ বলেন, ট্রমার ভেতরেও ফিরতে হচ্ছে স্বাভাবিক কার্যক্রমে। আমাদের এখানে ব্র্যাক, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং কলেজের নিজস্ব সাইকোলজিস্টদের সমন্বয়ে একটি যৌথ কাউন্সেলিং টিম কাজ করছে। শুরুতে ওয়ান-টু-ওয়ান সেশন হলেও এখন চলছে গ্রুপ কাউন্সেলিং। প্লে গ্রুপ থেকে শুরু করে ক্লাস ১২ পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং সেশনে অংশ নিতে বলা হয়েছে। আমাদের প্রায় প্রতিটি সেকশনে ২০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী থাকে। ফর্ম মাস্টারদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং সেশনে যুক্ত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহ থেকেই ট্রমাটাইজড শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে ডেকে এনে সেশন করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে সবার সঙ্গে কাজ করতে হবে। একটা সেশন যথেষ্ট না অনেকের ক্ষেত্রে ধারাবাহিক সেশন দরকার।
জিয়াউল আলম বলেন, অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করেই শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফেরানো হয়েছে। আমরা কাউকে জোর করিনি। ৯০ শতাংশ অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীর মতামত ছিল তারা ক্যাম্পাসে ফিরতে চায়। তারা বিশ্বাস করে, একসাথে থাকলে ট্রমা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রথম দুইদিন ছিল দোয়া মাহফিল এবং মানসিক প্রশমন কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত। ক্লাস হয়নি। তবে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে তাদের মানসিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন।
গত কয়েকদিনের কার্যক্রম প্রসঙ্গে অধ্যক্ষ জিয়াউল আলম বলেন, আমরা প্রথম থেকেই চেষ্টা করেছি গার্ডিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে। প্রতিটি হাসপাতালের সঙ্গে শিক্ষক প্রতিনিধি দল কাজ করেছে। আমরা চেষ্টা করেছি কোনো ত্রুটি না রাখার। তারপরও সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। তবে গার্ডিয়ানদের জানানো, মরদেহ শনাক্ত, চিকিৎসার সমন্বয় সব জায়গায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। বিমান বাহিনীর সহায়তায় পাঁচটি মরদেহ শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত সম্পন্ন করা হয়েছে। তিনজন শিক্ষার্থী ও দুইজন অভিভাবকের পরিচয় নিশ্চিত করে আমরা তাদের দাফনের ব্যবস্থা করেছি।
কলেজ থেকে প্রতি মুহূর্তে তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে গুজবের অবসান হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর থেকে মৃত্যু ও নিখোঁজ সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। গুজব ঠেকাতে আমরা বারবার যাচাই-বাছাই করেছি। অভিভাবকদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করেছি। সে অনুযায়ী ২৭ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক, ৩ জন অভিভাবক এবং ১ জন আয়াসহ দুর্ঘটনায় মোট ৩৪ জন নিহত হয়েছেন।
ঘটনার দিনের সেই ভয়াবহ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে অধ্যক্ষ বলেন, আমি যখন আগুন দেখি, প্রথমেই নিচে ছুটে আসি। দেখি দুইজন মাটিতে পড়ে আছে। আমাদের শিক্ষক, স্টাফ, এমনকি শিক্ষার্থীরাও তখন এগিয়ে আসে উদ্ধারকাজে। ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনী দ্রুত চলে আসায় বড় ক্ষতি অনেকটা রোধ করা গেছে। আর জেট ফুয়েলের আগুন সাধারণ আগুনের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি তাপ তৈরি করে। সেই ভয়াবহ আগুনের কারণেই প্রথম আঘাতটা সবচেয়ে মারাত্মক ছিল।
এই ক্ষতি কোনোদিনই পূরণ হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জানি, এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। যেসব অভিভাবক তাদের সন্তান হারিয়েছেন, তাদের জীবন আগের মতো হবে না কখনোই। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি পাশে থাকতে, কথা বলতে, অনুভব করতে। গোটা জাতি, মিডিয়া, বাহিনী সবাই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য আমরা কৃতজ্ঞ। এখন সময় একসাথে থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। শিক্ষার্থীরা আমাদের ভবিষ্যৎ তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা আমাদের কর্তব্য।
অন্যদিকে, বিমান দুর্ঘটনায় ট্রমায় থাকা শিক্ষার্থীরা চাইলেই অন্য যেকোনো শাখায় বদলি হতে পারবে। আবার কেউ চাইলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও উপদেষ্টা কর্নেল (অব.) নুরুন নবী। 
তিনি বলেন, যদি কোনো শিক্ষার্থী এখান থেকে অন্য কোনো ক্যাম্পাস বা শাখায় যেতে চায়, তবে অভিভাবকদের আমরা বলেছি তাদের যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যান। তবে এমন জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে তার বন্ধু-বান্ধব আছে, যেন সে মানসিক স্বস্তি খুঁজে পায়। নতুন কোনো জায়গায় গেলে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা মানিয়ে নিতে পারে না। বরং পরিচিত পরিবেশ, বন্ধু মহল বা ‘সার্কেল’ থাকলে তারা দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে। এ কারণেই অন্য শাখায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে পূর্বপরিচিতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
দুর্ঘটনায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসায় সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে নুরুন নবী বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খুব সহযোগিতা করছে। ইতোমধ্যে ভারত, চীন ও সিঙ্গাপুর থেকে দক্ষ চিকিৎসক আনা হয়েছে। এ ধরনের মানসিক ট্রমা কাটিয়ে উঠতে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন, সরকার সেটা নিশ্চিত করছে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে যে ভবনগুলো অক্ষত রয়েছে, সেগুলোতে পাঠদান কার্যক্রম চলবে। তবে যেটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে আপাতত কোনো ক্লাস বা শিক্ষা কার্যক্রম চলবে না। ওই জায়গায় এই মুহূর্তে ক্লাস পরিচালনা করার প্রশ্নই উঠে না। সরকার তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারাই ওই বিল্ডিং নিয়ে করণীয় ঠিক করবে।
কর্নেল (অব.) নুরুন নবী আরও বলেন, আমরা অভিভাবকদের অনুরোধ করেছি যদি কোনো শিক্ষার্থী ট্রমাটাইজ হয়ে থাকে এবং এখানে ক্লাসে ফিরতে না চায়, তবে তাকে যেন বাসায় বসিয়ে না রাখা হয়। বরং তাকে এমন কোনো শাখা বা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান, যেখানে তার পরিচিত পরিবেশ রয়েছে। কারণ, বাসায় বসে থাকলে তার মন থেকে দুর্ঘটনার বিষয়টি যাচ্ছেও না, বরং মানসিক চাপ আরও বাড়ছে।
দুর্ঘটনাকবলিত ক্যাম্পাস সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি সরকারের অনুমোদিত ক্যাম্পাস। রাজউক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষসহ প্রয়োজনীয় সব সংস্থার অনুমতি নিয়েই আমরা এখানে প্রতিষ্ঠান করেছি। সব নিয়মকানুন মেনেই অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এর বৈধতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সরকার নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসায় পূর্ণ সহযোগিতা করছে। আমরাও কলেজের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
উল্লেখ্য, বুধবার (৬ আগস্ট) থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।