২০২৪ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট পেশ করে। বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, বাংলাদেশ হেলথ কমিশন গঠন এবং শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠনসহ অনেকগুলো সুপারিশ এই রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত আছে। এই রিপোর্ট ঘিরে অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তিন মাসে সরকার থেকে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এর বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্যোগ কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। প্রথম তিন মাসে সরকারের করণীয় ঠিক করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা থাকলেও অর্থায়ন (ঐবধষঃযপধৎব ঋরহধহপরহম) খুব একটা মনোযোগ পায়নি। কিন্তু একটি শক্তিশালী অর্থায়ন ব্যবস্থা ছাড়া এই সংস্কারের রূপরেখা কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এর ফলে দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৭০ শতাংশই রোগীর নিজস্ব পকেট থেকে খরচ বহন করতে হয়। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বহু পরিবার শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করা, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া অথবা নিরুপায় হয়ে চিকিৎসা থেকে বিরত থাকার মতো পথ বেছে নিতে হয় এবং সঠিক অর্থায়ন কাঠামো ছাড়া কোনো সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা হলে তা বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও গভীর করতে পারে।
স্বাস্থ্য অর্থায়ন সংস্কার কেবল ‘অধিক তহবিল সংগ্রহ’ করাকে বোঝায় না। অর্থ কোথা থেকে আসবে, কার অবদান কতটুকু হবে, সংগ্রহের পদ্ধতি কী হবে এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণও এর অন্তর্ভুক্ত। স্বাস্থ্য কমিশনের সুপারিশ বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে নিশ্চিত করতে চাইলে একটি সঠিক ও টেকসই অর্থায়ন ব্যবস্থা দরকার।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে সংস্কারের শুরুতে অর্থায়ন কাঠামো ঠিকমত নির্ধারণ করা না গেলে পরে তা নিয়ে বেশ পোহাতে হয় এবং সংস্কারের আসল উদ্দেশ্য সাধন কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে। থাইল্যান্ড ২০০১ সালে সাধারণ কর (এবহবৎধষ ঃধী) ভিত্তিক ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ স্কিম চালু করা করে। কার্যকর অর্থায়ন নিশ্চিত করার ফলে সেখানে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (পধঃধংঃৎড়ঢ়যরপ যবধষঃয বীঢ়বহফরঃঁৎব) উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায় এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সেবার প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়।
ফিলিপাইনে শক্ত অর্থায়ন কাঠামো তৈরির পূর্বেই স্বাস্থ্য খাতকে স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় ধনী ও গরিব প্রদেশের মধ্যে সেবার মানের ব্যাপক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়েছিল।
একইভাবে রুয়ান্ডা তাদের দেশে চলমান যুদ্ধাবস্থার অবসান হওয়ার পর কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্যবীমা (গঁঃঁবষষবং ফব ঝধহঃল্ক) চালু করে। তবে সেখানে দরিদ্রতম নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সরকারি ভর্তুকি শুরু থেকেই অব্যাহত ছিল। এই প্রি-পেমেন্ট মডেলের ওপর নির্ভর করে দেশটি ৯০ শতাংশের বেশি জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় এনেছে। শ্রীলঙ্কাও বহু দশক ধরে বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে। ফলে সীমিত বাজেট সত্ত্বেও তারা স্বাস্থ্য সূচকে উল্লেখযোগ্য অর্জন সাধন করেছে।
অন্যদিকে শুরু থেকে অর্থায়নকে অবহেলা করার পরিণতি যে সুখকর হয় না সে উদাহরণও আছে। ফিলিপাইনে শক্ত অর্থায়ন কাঠামো তৈরির পূর্বেই স্বাস্থ্য খাতকে স্থানীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ায় ধনী ও গরিব প্রদেশের মধ্যে সেবার মানের ব্যাপক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়েছিল।
নাইজেরিয়ার ভালো স্বাস্থ্যনীতি থাকা সত্ত্বেও খণ্ডিত (ংবমসবহঃবফ) ও অপর্যাপ্ত অর্থায়নের কারণে তা জনগণের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো একটা জিনিস স্পষ্ট করে যে, স্বাস্থ্য সংস্কারের আগে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে না পারলে এমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি হয় যেখানে ধনী-গরিব বৈষম্য কমানোর পরিবর্তে বাড়াতে থাকে।
যদিও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ‘ইকুইটি ফান্ড’ (ঊয়ঁরঃু ঋঁহফ) মডেল যা কম্বোডিয়া ও লাওসের মতো দেশে সাফল্য পেয়েছে একটা আপাত সমাধান হতে পারে। কম্বোডিয়ায় এই ফান্ডটি সরকারি বাজেট ও ব্যক্তি পর্যায়ে ডোনেশনের মাধ্যমে গঠিত হয় যা থেকে দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে সেবার ব্যয়ভার বহন করা হয়।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় যে, যদি শুরুতেই অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তবেই একটি ন্যায়ভিত্তিক, টেকসই ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
এর মাধ্যমে সেবাকেন্দ্র থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের বিনামূল্যে সেবা দেওয়া যায়। একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন সংস্কার বাস্তবায়িত হওয়ার আগে বাংলাদেশের জন্য এই মডেলটি দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা প্রদানের একটি কার্যকর ও অন্তর্বর্তীকালীন সমাধান হতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে বিভিন্ন খাতে সংস্কারসহ স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার নিয়ে জনআকাঙ্খা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি সুস্পষ্ট আর্থিক রূপরেখা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি। এই রূপরেখার মধ্যে থাকতে হবে আগামী পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অংশ ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম ২.৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা।
একইসাথে আনুষ্ঠানিক (ভড়ৎসধষ) খাতের কর্মীদের জন্য সামাজিক স্বাস্থ্যবীমা চালু করার মাধ্যমে সমন্বিত তহবিল (ঢ়ড়ড়ষবফ ভঁহফ) গঠন করতে হবে। তবে একই সাথে অনানুষ্ঠানিক (রহভড়ৎসধষ) খাতের সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ডেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর তাৎক্ষণিক সুরক্ষা দিতে একটি ইকুইটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে যা ভবিষ্যতে সর্বজনীন ব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত হবে। তাছাড়া সিনট্যাক্স সংস্কার করে তা থেকে অর্জিত অতিরিক্ত অর্থ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করলে স্বাস্থ্য খাতের জন্য পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তি কঠিন কাজ হবে না।
রাজনৈতিকভাবে সহজ অংশগুলো আগে বাস্তবায়ন করা হবে নাকি গোঁড়া থেকেই শুরু করবে এই প্রশ্ন প্রতিটি সংস্কার কমিশনের সামনেই থাকে। একটা মৌলিক সংস্কার কঠিন হলেও এর ফলাফল দীর্ঘস্থায়ী হয়। আর যেকোনো সংস্কারের ক্ষেত্রেই অর্থায়ন ব্যবস্থার সংস্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় যে, যদি শুরুতেই অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় তবেই একটি ন্যায়ভিত্তিক, টেকসই ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। আর যদি এই কাজটি ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখা হয় তাহলে আমাদের বছরের পর বছর কেবল অসম্পূর্ণতাগুলো পূরণেই বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে। এর ফলে সৃষ্ট অব্যবস্থার শিকার হতে হবে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত মানুষগুলোরই।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
অধ্যাপক ও পরিচালক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মতামত লিখুন : :