বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা শুধু শাসনের হাতিয়ার নয়, এটা এক অদৃশ্য ধনকুব, যেখানে লুকিয়ে থাকে অগণিত সুযোগ-সুবিধা, টাকা, পদ-পদবি, প্রভাব ও নিরাপত্তা। ক্ষমতার সান্নিধ্য মানেই অনেকের কাছে সুযোগের পাহাড়, যা পেতে তারা নীতি-নৈতিকতা ফেলে, আদর্শের সঙ্গে আপোষ করে। ক্ষমতার প্রতিটি পালাবদল যেন এক মহোৎসব, যেখানে সুযোগসন্ধানীরা একত্রে নিজেদের স্থান পাকাপোক্ত করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। আজ যারা সরকারের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন, কাল তারা হয়ে উঠছেন বিরোধীদলের উগ্র সমর্থক। এরা সেই মৌসুমি পাখির মতো, যাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ বছরের বদলে ‘ক্ষমতার মৌসুমে’ পরিবর্তিত হয়।
বর্তমানে দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, উপদেষ্টা, আমলা, এমনকি জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত হাওয়া বুঝে ফেলেছেন আসছে সময়ে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। তাই তারা আগেভাগেই নানা কৌশলে বিএনপি জামায়াতের তোষামোদ শুরু করছেন, যেন ক্ষমতা বদলালে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়।
মৌসুমি পাখির রাজনীতি: দেশের জন্য এক ভয়াবহ অভিশাপ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশেষ প্রজাতির মানুষ জন্মেছে যাদের আমরা ‘মৌসুমি পাখি’ বলি। এরা কখনো দেশের জন্য নয়, নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজ করে। এদের লক্ষ্য ক্ষমতার স্রোতের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানো। মৌসুমি পাখিরা ক্ষমতার পালাবদল হলে দল, মতবাদ, আদর্শ ও মূল্যবোধ বার বার বদলান। একসময়ে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা নিয়ে বক্তৃতা করেন, পরের দিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। কখনো তারা সৎ মানুষের মতো ভেসে ওঠে, আবার কখনো মিথ্যা ও অন্ধ বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়।
এই মৌসুমি পাখির রাজনীতি দেশকে বিভক্ত করে, মানুষের মাঝে অবিশ্বাসের বীজ বুনে। এরা দেশের বদলে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে ব্যস্ত। এদেরই কারণে দেশ বারবার অস্থিতিশীলতায় ভুগছে, যেখানে সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বড় শিকার।
বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদ: সত্যের মুখোশে ধোঁকাবাজি
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদ করা। যাদের কাছ থেকে জনগণ সত্য ও ন্যায়বিচার আশা করে, তারা নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য নেতাদের গুণগান গাইতে পিছপা হয় না।
বুদ্ধিজীবীরা নানা সময় ক্ষমতাসীন বা সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন নেতাদের প্রশংসায় মেতে উঠেন, তাদের ছোটখাটো দুর্নীতি কিংবা অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডও যুক্তি দিয়ে ‘বুঝিয়ে’ দিতে চেষ্টা করেন। এতে তারা আসলে নিজেরা রাজনীতির অংশীদার হয়ে দাঁড়ান, নিজের পেশাগত সততা বিক্রি করেন।
এদের বক্তৃতা, লেখালেখি বা পরামর্শে দেখা যায়, কোনো নেতার অসাধু কাজ গোপন বা প্রশ্রয় দেওয়া হয়, অথচ সাধারণ মানুষের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়। এভাবে তারা ক্ষমতার কাছে গিয়েই নিজেদের ভাবমূর্তির মূল্য কমিয়ে ফেলে এবং সমাজের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল করে।
এই তোষামোদ শুধু বুদ্ধিজীবীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে না, বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দাসত্বের দিকে ঠেলে দেয়-যেখানে নেতারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা গ্রহণ করতে রাজি নয়, আর বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের এই অহংকারে পঙ্কিল হয়ে যায়।
অতএব, সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী হওয়া মানে হলো কেবল ক্ষমতার পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং দেশের কল্যাণে অবিচল থেকে দোষত্রুটির বিরুদ্ধে সাহসী সমালোচনা করা। তোষামোদ নয়, বরং সততার মশাল হাতে নিয়ে জনগণের পক্ষে লড়াই করা বুদ্ধিজীবীর প্রকৃত পরিচয়।
সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতার অবক্ষয়: তেলেমি ও তার পরিণতি
সাংবাদিকতা হচ্ছে সত্য প্রকাশের পেশা, কিন্তু আজকের অনেক সাংবাদিকের কাছে এটি শুধুমাত্র টিকে থাকার কৌশল। যেখানে আজকের দিনে কোনো চ্যানেলে সরকারের প্রশংসা হয়, সেখানে পরের দিন একই চ্যানেলে বিরোধীদলের জয়গান শোনা যায়। দিনে মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে রাতে বিরোধী নেতার সঙ্গে চা-কফি খাওয়া এখন টিকে থাকার রণনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা নিজেদের ‘নিরপেক্ষ’ দাবি করে, কিন্তু সত্য ও ন্যায় থেকে অনেক দূরে।
সাংবাদিকদের এই তেলেমি সংস্কৃতি এখন দেশের গণমাধ্যমকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। জনগণ আর তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না, কারণ তারা বুঝতে পারছে অনেক সাংবাদিকই ক্ষমতার দোসর হয়ে গেছে। আর এ সুযোগে রাজনৈতিক দোসর ও স্বার্থান্বেষীরা সাংবাদিকদের ব্যবহার করে নিজেদের দুঃশাসন ও ক্ষমতা সুনিশ্চিত করছে।
সাংবাদিকদের তেলেমি ও অসৎ আচরণের কারণে দেশে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে তাদের গায়ে হাত তোলা, হুমকি দেওয়া, এবং বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক হয়রানির ঘটনা বাড়ছে।
এই পরিস্থিতি সাংবাদিক পেশার মর্যাদাকে ধ্বংস করছে, এবং প্রকৃত সত্য ও ন্যায় প্রকাশের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত না করলে গণমাধ্যমে সত্যনিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।
আমলাতন্ত্রের নরম বাঁক: দ্বৈত ভূমিকা ও ক্ষমতার খেলাধুলা
আমলা, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার—তাদের আনুষ্ঠানিক পরিচয় “গণসেবক” হলেও বাস্তবে অনেকের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে “ক্ষমতাসেবক”। তারা সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে নামেন না, কিন্তু ক্ষমতার রঙ বুঝতে তারা রঙমিস্ত্রির মতোই পারদর্শী। সরকারি সভায় তারা নীতি বাস্তবায়ন ও উন্নয়নের ফুলঝুরি ছড়ান, কিন্তু পর্দার আড়ালে গোপনে সম্ভাব্য নতুন ক্ষমতাসীনদের কাছে বার্তা পাঠান
“সময় এলে আমরা আছি আপনার পাশে।”
তাদের মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতার পালাবদলে নিজের চেয়ার অটুট রাখা। ফলে তারা জনগণের সমস্যা সমাধানের চেয়ে শাসকদের মনোরঞ্জনে বেশি সময় ব্যয় করেন। যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের খুশি করার জন্য নীতি বদলানো, নিয়ম লঙ্ঘন করা কিংবা জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়াও তাদের কাছে অস্বাভাবিক নয়।
এই আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে জনগণের স্বার্থ বারবার বিসর্জন দিতে হয়। সাধারণ মানুষের অভিযোগ উপেক্ষা করা হয়, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া জটিল ও দুর্বিষহ করে তোলা হয়, আর ক্ষমতাসীনদের অপকর্ম ঢেকে দেওয়াই হয়ে দাঁড়ায় প্রধান কাজ। এর ফলে দেশ পরিচালনায় যোগ্যতা ও ন্যায়বোধের পরিবর্তে টিকে থাকে তোষণনীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা।
অবশেষে, এই আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি একদিকে জনগণকে বঞ্চিত করছে, অন্যদিকে ক্ষমতার দালালি করে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে আরও শক্তিশালী করছে যা রাষ্ট্রের জন্য এক নীরব বিপদ।
উপদেষ্টাদের দ্বিমুখী খেলা: লাভের জন্য আদর্শের পরিত্যাগ
দেশের বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও রাজনৈতিক উপদেষ্টারা যাদের ওপর বর্তমান ও সম্ভাব্য সরকারের নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব অর্পিত থাকে, তারা বাস্তবে কতটা দায়বদ্ধ তা প্রশ্নবিদ্ধ।
অনেক সময় দেখা যায়, এরা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য রাজনৈতিক দল ও সরকারের সঙ্গে দ্বিমুখী খেলা চালায়। আজকে তারা বর্তমান সরকারের পক্ষে পরামর্শ দিয়ে সুবিধা গ্রহণের চেষ্টা করে, আর আগামী দিনের সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে গোপনে ‘চুক্তি’ পাকাপোক্ত করে নিজেদের অবস্থান নিরাপদ করে নেয়।
এই ধরনের দায়িত্বহীনতা দেশের স্বার্থকে অবহেলা করা ছাড়া কিছু নয়। উপদেষ্টারা আদর্শ, নীতি ও দায়িত্বকে পেশাদারিত্বের ছদ্মবেশে লুকিয়ে রেখে স্বার্থসিদ্ধির পথেই চলেন। দেশের জন্য গঠনমূলক ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গড়ে তোলার পরিবর্তে তারা স্বল্পমেয়াদি লাভ ও রাজনৈতিক সুবিধার পেছনে ছুটে চলছেন।
ফলে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, জনগণের বিশ্বাস ভেঙে পড়ে, আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি দুর্বল হয়। এদের এই অনৈতিক ভূমিকা দেশের গণতন্ত্র ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।
তাই উপদেষ্টাদের পরিবর্তনই নয়, তাদের এই দায়িত্বহীন মনোভাব ও স্বার্থপরতাকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। প্রয়োজন এমন সৎ ও দায়িত্বশীল উপদেষ্টাদের যাঁরা দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবেন এবং ন্যায়নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে কাজ করবেন।
এই দ্বিমুখীতা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিষাক্ত করছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করছেন বর্তমান সরকারের উপদেষ্টারা।
জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা: সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ
এই তোষামোদ শুধু রাজনৈতিক অসততা নয়, এটি জনগণের সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। জনগণ আশা করে বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সত্য ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু তারা দেখতে পায় এই শ্রেণির অনেকেই ক্ষমতার দোসর হয়ে গেছে। ফলে মানুষের মধ্যে আস্থা হারিয়ে যায়, তারা মনে করে “সবাই নিজের জন্য, কেউ দেশের জন্য নয়।”
এই অবস্থা দেশের গণতন্ত্র ও সমাজকে দুর্বল করে, যা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হতে পারে।
শান্তির অনিশ্চয়তা: কেন আসছে না স্থায়ী শান্তি?
যখন সততার চেয়ে তোষামোদ বড় হয়ে যায়, নীতির চেয়ে স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন দেশে শান্তি আসা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ক্ষমতা বদলালেও মৌসুমি পাখিদের চরিত্র বদলায় না। আজ বিএনপির, জামায়াতে ইসলামীর তোষামোদ, কাল অন্য কারো। বাংলাদেশের রাজনীতি যেন এক অনন্ত নাটক-অভিনেতা বদলায়, কিন্তু স্ক্রিপ্ট অপরিবর্তিত থাকে। এই চক্র ভাঙার জন্য প্রয়োজন দেশপ্রেমিক ও দায়বদ্ধ নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, যা শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাস করে।
পরিবর্তনের পথ: কিভাবে ভাঙা যাবে তোষামোদি সংস্কৃতি?
যদি আমরা সত্যিই শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন চাই, তবে এই তোষামোদি সংস্কৃতিকে ভাঙতে হবে। সাংবাদিকরা সত্যিকারের সাংবাদিক হতে হবে, নিজের পেশার নীতি মেনে চলতে হবে। বুদ্ধিজীবীরা জনগণের স্বার্থে কথা বলবে, স্বার্থান্বেষী স্বভাব ত্যাগ করবে। আমলারা জনগণের সেবক হবে, ক্ষমতার দাস নয়। এই দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সবাইকে মিলে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন করতে হবে। নইলে দেশ থেকে সত্যিকারের পরিবর্তন দূরে থাকবে।
সমাপ্তি
ক্ষমতার পালাবদলে সুযোগসন্ধানীদের হিড়িক থামানোর জন্য প্রয়োজন ঐকমত্য, দায়িত্ববোধ ও সততার পুনর্জাগরণ। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সত্যনিষ্ঠা, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা না হলে, শুধু সরকার বদলালেই দেশের মানুষের ভাগ্য বদলানো সম্ভব হবে না।
সুতরাং, আমরা প্রত্যেকে বুদ্ধিজীবী হোন, সাংবাদিক হোন, আমলা বা সাধারণ নাগরিক সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়ন ও শান্তির জন্য কাজ করব। তখনই হবে একটি বাস্তব ও স্থায়ী পরিবর্তন, যা আমাদের সোনার বাংলাদেশের দেশের জন্য এক নতুন সূচনা হবে।
লেখক: সোহাইল আহমেদ
গণমাধ্যমকর্মী, কলামিস্ট, শিক্ষক ও সংগঠক।
আপনার মতামত লিখুন : :