• ঢাকা
  • বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ২৬ ভাদ্র ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.
উ ন্ন য় ন ভাবনা

জনসংখ্যা বোঝা নয়, সুবর্ণ সুযোগ


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | কবীর আহমেদ ভূঁইয়া আগস্ট ২৩, ২০২৫, ১০:০১ এএম জনসংখ্যা বোঝা নয়, সুবর্ণ সুযোগ

বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বিশাল জনসংখ্যাকে সাধারণত বোঝা হিসেবে দেখা হয়। তবে জনসংখ্যা নিজে কোনো ‘সমস্যা’ নয়; সমস্যাটি হলো সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযোগহীনতা। জনসংখ্যাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ না দেখে ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে দেখা দরকার। উন্নত বিশ্বের বার্ধক্যজনিত শ্রম সংকট ও দক্ষ কর্মীর অভাবে বাংলাদেশিরা নতুন করে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে উচ্চমূল্য পাচ্ছে। এই পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন সম্ভব।
১. বাংলাদেশে জনসংখ্যার বর্তমান অবস্থা ও কর্মক্ষমতা: জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৭%-অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি মানুষ-কর্মক্ষম বয়সের (১৫-৫৯ বছর) মধ্যে। তবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের মাত্রা ও দক্ষতার মধ্যে বিরাট ফাঁক বিদ্যমান। বর্তমানে আনুমানিক ২.৭ কোটি যুবক কর্মহীন অথবা আংশিকভাবে নিযুক্ত, যাদের একটি বড় অংশ অর্ধশিক্ষিত এবং দক্ষতা প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত এই পরিস্থিতি একটি দ্বৈত চ্যালেঞ্জ-অভ্যন্তরীণ বাজারে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই এবং দক্ষ কর্মী হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রস্তুতিও অনুপস্থিত। তাই আমাদের যুবসমাজকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
২. আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের বিশ্লেষণ ও বাংলাদেশের অবস্থান: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রায় ৬৫৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো-বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান-অগ্রগণ্য। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ২৭.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বিশ্ব জুড়ে বিশেষ করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার কারণে দক্ষ শ্রমিকের অভাব প্রকট। উদাহরণস্বরূপ: জার্মানিতে আগামী ১০ বছরে ৭০ লাখের বেশি নতুন দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। কানাডা প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ অভিবাসী নিচ্ছে, যেখানে দক্ষ শ্রমিকদের জন্য দ্রুত প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। জাপানের ঝঝড প্রোগ্রামে ১৪টি খাতে বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় কৃষি, নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও ওঈঞ খাতে শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে দক্ষ শ্রমিক তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুযোগ অত্যন্ত বিশাল।
৩. দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ফাঁক বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ; বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিক দক্ষতার অভাবে নিম্ন মজুরি চাকরিতে নিয়োজিত। যেমন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চ শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ থাকায় শত শত হাজার তরুণ কর্মহীন। এ ছাড়া, ভাষা ও আন্তর্জাতিক কাজের সংস্কৃতি বুঝার অভাব। আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের ঘাটতি। দক্ষতার স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেটের অভাব। এসব সমস্যা দূর না হলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
৪. আন্তর্জাতিক সফল মডেল থেকে শিক্ষা: বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন ফিলিপাইন, ভারত ও ভিয়েতনাম দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির ক্ষেত্রে আধুনিক প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা, আইনি সুরক্ষা ও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় সফল হয়েছে। ফিলিপাইন ঙঋড মডেল কর্মী প্রশিক্ষণ, আইনি সুরক্ষা ও রেমিট্যান্স ব্যবস্থাপনায় বিশেষভাবে সফল। ভারত ঘজও-এর জন্য বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা ও ঋণ ব্যবস্থা চালু করেছে। ভিয়েতনাম দক্ষ শ্রমিক প্রস্তুতিতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে। বাংলাদেশও এসব মডেল থেকে নীতিগত শিক্ষা নিতে পারে।
৫. করণীয় ও রোডম্যাপ: জনসংখ্যা থেকে মানবসম্পদ রূপান্তর: দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তোলা-প্রতিটি জেলায় আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যেখানে আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশন যেমন ওঝঙ, ঙঝঐঅ, ঘঠছ দেয়া হবে। ঊট ইষঁব ঈধৎফ, জার্মান চভষবমবশৎব্ধভঃব, কানাডার ঊীঢ়ৎবংং ঊহঃৎু-এর মতো প্রস্তুতি দেয়া হবে।
ভাষা শিক্ষা প্রসার-ঞঙঊঋখ, ওঊখঞঝ ছাড়াও জাপানি, কোরিয়ান, জার্মান, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি ও আন্তর্জাতিক চুক্তি-জার্মানি, কানাডা, জাপান, ফিনল্যান্ড, ইউকে, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বৈধ শ্রম বাজার চুক্তি করতে হবে যাতে দালাল শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করতে পারে এবং শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আমরা যদি বিদেশে আমাদের হাইকমিশনগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে শ্রমবাজার তৈরি করি এবং যেসব অভিবাসী সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থান করছে তাদেরকে যথাযথ নার্সিং করি এবং তাদেরকে সঠিক ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করি তাহলে অতি দ্রুত বিদেশের বাজারে বাংলাদেশি জনশক্তি নেতৃত্ব দিতে পারবে। 
ডিজিটাল রেজিস্ট্রেশন ও স্মার্ট কন্ট্রাক্ট-কর্মীদের তথ্য, ভিসা, প্রশিক্ষণ ও চুক্তি ব্লকচেইনভিত্তিক প্ল্যাটফরমে সংরক্ষণ করতে হবে, যা মানব পাচার রোধ ও সরকারি নজরদারি সহজ করবে।
রেমিট্যান্স বিনিয়োগ ও কর প্রণোদনা-বিদেশ ফেরত শ্রমিকদের গঝগঊ, কৃষি, ই-কমার্স ও রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগের জন্য সহজ ঋণ ও কর ছাড় প্রদান করতে হবে।
সম্ভাব্য আর্থিক লাভ ও জাতীয় প্রভাব- ২ কোটি দক্ষ শ্রমিক যদি বছরে গড়ে ১৫,০০০, ২০,০০০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠায়, তাহলে বছরে ৩০০-৪০০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসবে। এটি বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়িয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনীতির বহুমাত্রিক উন্নয়নে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বোঝা নয়, বরং একটি বিশাল মানবসম্পদ। যথাযথ দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রস্তুতির মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি বৈশ্বিক দক্ষ শ্রমিক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। অতএব, এখন সময় কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা না করে, সেই জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে দেশের উন্নয়ন যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করার। রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, যুগোপযোগী নীতিমালা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করলেই বাংলাদেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানবসম্পদ রপ্তানিকারক দেশ হতে পারবে।
লেখক: উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদ, রাজনীতিক, চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া গ্লোবাল ফাউন্ডেশন

Side banner