• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট, ২০২৫, ২৩ শ্রাবণ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ:

এনসিপি’র বুদ্ধিভিত্তিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | অ্যাড. মীর হালিম  আগস্ট ৬, ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম এনসিপি’র বুদ্ধিভিত্তিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ

জুলাই ঘোষণাপত্র হলো ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি দলিল, যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে মূলত জুলাই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, অর্জন এবং ভবিষ্যতে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হয়েছে। ঐতিহাসিক ‘৩৬ জুলাই উদযাপন’ অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল ৫ আগস্ট ২০২৫ ইং তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা, ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই ২৮ দফার এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকর হিসাবে গণ্য হবে। প্রথম ২১টি দফায় মূলত ঐতিহাসিক ও বিপ্লবের পূর্বশর্ত তুলে ধরেছে, পরবর্তী দফাগুলোতে সংবিধান, বিচার, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সংস্কার নিয়ে অঙ্গীকার রয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রটি ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য, অর্জন এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা নিয়ে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে রাজনৈতিক দলসমূহ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত দিয়েছে। এই ঘোষণাপত্র মূলত ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা একটি দলিল। 
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই ঘোষণাপত্রেকে ইতিবাচক মনে করলেও কিছু বিষয়ে বাদ পড়েছে বলে মনে করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও গণসংহতি আন্দোলন স্বাগত জানিয়েছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন হতাশা ব্যক্ত করে বলেছে শীঘ্রই তারা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া হয়তো শীঘ্রই জানা যাবে। বিশ্লেষকরা নানাভাবে এর দুর্বলতা ও আইনি ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করছেন! জুলাই ঘোষণাপত্র যদি বর্তমান সংবিধানের (আলোচিত সংস্কার সংশোধনীর পর) চতুর্থ তফসীলের অংশ হয় তাহলে এনসিপির নতুন সংবিধান রচনার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল! জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়বস্তু ও ভাষাগত সৌন্দর্যের মধ্যে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণায় এমন দুর্বল ড্রাফটিং জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি অবহেলা বলে মনে হয়। এই ঘোষণাপত্রে জুলাই বিপ্লবের মূল স্পিরিট সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হওয়ায় এর মূল ধারক ও বাহক কোটাবিরোধী বা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, এনসিপি’র বুদ্ধিভিত্তিক দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। 
২৮ দফাকে সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি ও গুরুত্ব দিয়েছেন মর্মে বোঝা যায়। ১. গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি;
২০২৪ সালের ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির অঙ্গীকার। আসন্ন পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র অন্তর্ভুক্ত করার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। ২. শহীদদের সম্মান;
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁদের পরিবার এবং আন্দোলনে আহত ও নির্যাতিতদের সকল প্রকার আইনি সুরক্ষা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি। ৩. সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার;
জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক সংবিধানসহ সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার করার প্রত্যয়।  ৪. ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ; দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্গঠনের অঙ্গীকার যাতে ভবিষ্যতে কোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী বা অগণতান্ত্রিক শাসনের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ৫. বিচার ও জবাবদিহিতা; ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনে সংঘটিত সকল গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের বিচার দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি। ৬. সুশাসন ও মানবাধিকার;
আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। ৭. টেকসই উন্নয়ন; পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি। 
জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা জানায়, যা জুলাই ঘোষণাপত্র নামে পরিচিত। ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এটির প্রকাশ ঘোষণা করে এবং ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশের সময়সূচি নির্ধারণ করে। এই ঘোষণার সময় হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন যে, ঘোষণাপত্রের উদ্দেশ্য হলো আওয়ামী লীগকে—একটি নাৎসি শাসনের সাথে তুলনা করে—অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের কবর রচনা করা। যদিও সরকার প্রাথমিকভাবে এতে জড়িত ছিল না, পরবর্তীতে তারা এই উদ্যোগে যুক্ত হয় এবং শাসন-সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংস্কার কমিশনগুলোর আলোচনা শুরু হয়। একই সময়ে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলতে থাকে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ের শুরুতে ঘোষণাপত্রের একটি প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করা হয় এবং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতামত চাওয়া হয়। ১ আগস্টের মধ্যে সরকার-সমর্থিত দুই ছাত্র উপদেষ্টা নিশ্চিত করেন যে চূড়ান্ত সংস্করণটি ৫ আগস্টের আগে প্রকাশ করা হবে। সম্প্রতি ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন।
জুলাই ঘোষণাপত্র: মূলপাঠের কপি, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকা, বাংলাদেশ, তারিখ: ৫ই আগস্ট ২০২৫ ইংরেজি 
১। যেহেতু উপনিবেশ বিরোধী লড়াইয়ের সুদীর্ঘকালের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল; এবং ২। যেহেতু, বাংলাদেশের আপামর জনগণ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিবৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে; এবং ৩। যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রনয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছিল এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল; এবং ৪। যেহেতু স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে বাকশালের নামে সাংবিধানিকভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করে এবং মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়, এবং ৫। যেহেতু আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় বছর ছাত্র-জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ইং সনে পুনরায় সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এবং ৬। যেহেতু দেশী-বিদেশী চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১ -এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়; এবং ৭। যেহেতু গত দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলে একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়; এবং ৮। যেহেতু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, আইন-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং একদলীয় স্বার্থে সংবিধান সংশোধন ও পরিবর্তন বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধ্বংস করে; এবং ৯। যেহেতু, হাসিনা সরকারের আমলে তারই নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক, ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে; এবং ১০। যেহেতু, তথাকথিত উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নেতৃত্বে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে বিগত পতিত দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ ও এর অমিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে তোলে এবং এর পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও জলবায়ুকে বিপন্ন করে; এবং ১১। যেহেতু শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ গত প্রায় ষোল বছর যাবত নিরন্তর গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা, গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়; এবং ১২। যেহেতু বাংলাদেশে বিদেশী রাষ্ট্রের অন্যায় প্রভুত্ব, শোষণ ও খবরদারিত্বের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে বহিঃশক্তির তাবেদার আওয়ামী লীগ সরকার নিষ্ঠুর শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করে; এবং ১৩। যেহেতু অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে; এবং ১৪। যেহেতু, আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারী চাকুরীতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকুরী প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়; এবং ১৫। যেহেতু বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ওপর চরম নিপীড়নের ফলে দীর্ঘদিন ধরে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং জনগণ সকল বৈধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যায়; এবং ১৬। যেহেতু, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিলোপ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ব্যাপক দমন-পীড়ন, বর্বর অত্যাচার ও মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, যার ফলে সারা দেশে দল-মত নির্বিশেষে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণবিক্ষোভ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়; এবং ১৭। যেহেতু ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে অদম্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ যোগদান করে এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বাহিনী রাজপথে নারী-শিশুসহ প্রায় এক হাজার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে, অগনিত মানুষ পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণ করে এবং আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ জনগণের গণতান্ত্রিক লড়াইকে সমর্থন প্রদান করে; এবং ১৮। যেহেতু, অবৈধ শেখ হাসিনা সরকারের পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে জনগণ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে, পরবর্তী সময়ে ৫ আগস্ট ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ পরিচালনা করে এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনরত সকল রাজনৈতিক দল, ছাত্র-জনতা তথা সর্বস্তরের সকল শ্রেণী, পেশার আপামর জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণভবনমুখী জনতার উত্তাল যাত্রার মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়; এবং ১৯। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট মোকাবেলায় গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রত্যয় ও প্রয়োগ রাজনৈতিক ও আইনি উভয় দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত, বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত; এবং ২০। যেহেতু জনগণের দাবি অনুযায়ী এরপর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রীম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়; এবং ২১। যেহেতু, বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণের ফ্যাসিবাদবিরোধী তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়; এবং  ২২। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে; এবং ২৩। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ বিগত ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম কালে এবং ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালীন সময়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক সংঘটিত গুম-খুন, হত্যা, গণহত্যা, মানবতা বিরোধী অপরাধ ও সকল ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুণ্ঠনের অপরাধসমূহের দ্রুত উপযুক্ত বিচারের দৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে; এবং ২৪। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ জুলাই গনঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করে শহীদদের পরিবার, আহত যোদ্ধা এবং আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে প্রয়োজনীয় সকল আইনি সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। এবং ২৫। সেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ যুক্তিসঙ্গত সময়ে আয়োজিতব্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদে প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে। এবং 
২৬। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণ এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে একটি পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষিত হবে। এবং ২৭। বাংলাদেশের জনগণ এই অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। এবং ২৮। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই ঘোষণাপত্র প্রনয়ণ করা হলো। 
জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদের (ঔঁষু উবপষধৎধঃরড়হ ধহফ ঔঁষু ঈযধৎঃবৎ) মাঝে পার্থক্য রয়েছে! জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো শীঘ্রই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার আলাপ চলমান। এই ঘোষণাপত্রের ধারাবাহিকতায় জুলাই সনদ হবে বলে অনুমান করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করার পর সেটি জুলাই সনদ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় জুলাই ঘোষণাপত্রের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের উপর নির্ভরশীল। এটি কেবল একটি দলিল নয়, বরং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত পরিবর্তন এবং রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক কাঠামোতে যে নতুন ধারার সূচনা হয়েছে, তার একটি প্রতিচ্ছবি। সমঝোতার ভিত্তিতে এসব পরিবর্তনের বাস্তবায়নই জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের চূড়ান্ত গতিপথ নির্ধারণ করবে। একথা অনস্বীকার্য যে, রাজনৈতিক দর্শন, ঐতিহাসিক ঘোষণা এবং সাংবিধানিক সংস্কার—সবকিছুই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়, আর এটাই ইতিহাসের চিরন্তন শিক্ষা।
লেখক: অ্যাড. মীর হালিম 
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও 
পাবলিক পলিসি অ্যানালিস্ট।