বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বরাবরই অবহেলিত। কম বাজেট বরাদ্দ, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, সেবার নিম্নমান, বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় অর্থাৎ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দরিদ্র হয়ে যাওয়া, সেবা প্রাপ্তিতে ধনী-গরিব বৈষম্য স্বাস্থ্য খাতের পুরোনো সমস্যা। তাই এই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা ছাড়া ভালো কিছু আশা করা কঠিন।
তবে স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্খিত উন্নয়ন আনতে গেলে শুধু ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়, টেকসই অর্থায়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে, ‘সিন ট্যাক্স (ঝরহ ঞধী)’ বা ক্ষতিকর দ্রব্যের ওপর উচ্চমাত্রায় করারোপ একটি ভালো সমাধান হতে পারে। পাশাপাশি এটা স্বাস্থ্য খাতের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করার পথও তৈরি করে দিতে পারে।
বিশ্বজুড়ে বহু দেশ ইতিমধ্যে সিন ট্যাক্স সংস্কার করেছে এবং তাতে সফলও হয়েছে। ফিলিপাইনের উদাহরণই ধরা যাক। ২০১২ সালে দেশটি তামাক ও অ্যালকোহলের ওপর উচ্চ ও স্পেসিফিক কর (শতকরা হিসেবে নয়, বরং করের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া যেমন, এক প্যাকেটে ৫০ টাকা, দাম যাই থাকুক) আরোপ করে এবং এর থেকে অর্জিত আয় ‘চযরষঐবধষঃয’ নামক জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা কর্মসূচিতে ব্যয় করে।
এর ফলে রাজস্ব আয় দ্বিগুণ হয়, ধূমপান ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং প্রায় ১৫ মিলিয়নের বেশি দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আসে। একদিকে যেমন সরকারের আয়ের আকার বাড়ে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হয় এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিমার আওতায় আসে, যাকে ‘ত্রিপল উইন (ঞৎরঢ়ষব ডরহ)’ বলা যায়।
থাইল্যান্ডও তামাক ও অ্যালকোহলের ওপর উচ্চহারে কর ধার্য করে। সেই অর্থ ব্যবহারের জন্য ঞযধরঐবধষঃয ঋড়ঁহফধঃরড়হ নামক একটি স্বাধীন তহবিল গঠন করে। এই তহবিল থেকে স্বাস্থ্য সচেতনতা, ক্যান্সার প্রতিরোধ, সড়ক নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থায়ন করা হয়। সিন ট্যাক্স থেকে অর্জিত আয় সরাসরি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়। এগুলো করতে তেমন কোনো প্রশাসনিক জটিলতাও লক্ষ্য করা যায়নি।
মেক্সিকো ২০১৪ সালে চিনিযুক্ত পানীয়ের ওপর কর আরোপ করে এবং মাত্র দুই বছরে এ ধরনের পানীয়ের চাহিদা ১২ শতাংশে হ্রাস পায়। এর থেকে অর্জিত রাজস্ব ব্যবহার করে স্কুলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও জনসচেতনতা কার্যক্রম চালু করে। দক্ষিণ আফ্রিকাও ২০১৮ সালে ঐবধষঃয চৎড়সড়ঃরড়হ খবাু নামে চিনির মাত্রার ওপর ভিত্তি করে কর নির্ধারণ করে। এতে ২৯ শতাংশ পর্যন্ত চিনি-পানীয়ের বিক্রি হ্রাস পায় এবং এই ধরনের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অগ্রগতি অর্জন করে।
সিন ট্যাক্স থেকে অর্জিত আয় সরাসরি জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়। এগুলো করতে তেমন কোনো প্রশাসনিক জটিলতাও লক্ষ্য করা যায়নি।
তবে এই তালিকায় একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে থাকবে আফ্রিকার ছোট একটি দেশ গাম্বিয়া। গাম্বিয়া একদিকে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর একটি, আবার অন্যদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও কর সংস্কারে তাদের অবস্থান অত্যন্ত শক্ত। তারা একাধিক স্তরের কর সরল করে উচ্চ কর নির্ধারণ করেছে, পাশাপাশি ন্যূনতম খুচরা মূল্য নির্ধারণ ও কর ফাঁকি রোধে কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করেছে।
মজার বিষয় তাদের সাফল্যের পেছনে এই বিষয়ে বাংলাদেশের একজন এক্সপার্ট পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন যা বিশ্বে বেশ সমাদৃত হয়েছে, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এর উদাহরণ অনেক জায়গায় ব্যবহার করেছে যদিও বাংলাদেশ সরকার তার পরামর্শ শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি। গাম্বিয়া দেখিয়েছে কম অর্থনৈতিক সম্পদের দেশ হয়েও সাহসী সিন ট্যাক্স সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব এবং তার সুফলও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশেও সিন ট্যাক্স সংস্কারের সুযোগ রয়েছে এবং তা হওয়া দরকারও। দেশে প্রায় ৩.৮ কোটি মানুষ তামাক ব্যবহার করেন এবং ধূমপানজনিত রোগে প্রতিবছর মৃত্যু হয় প্রায় ১.৬ লাখ মানুষের। বর্তমানে আমাদের তামাক কর কাঠামো বহু স্তরবিশিষ্ট এবং জটিল। সুনির্দিষ্ট কর না হওয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দামের ব্র্যান্ড রেখে কর এড়াতে বা দাম কম রাখতে সক্ষম হয়। আমাদের একটি গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, কর কাঠামো সরল এবং করের হার বৃদ্ধি করলে প্রতিবছর অতিরিক্ত ২০,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন সম্ভব যা স্বাস্থ্যখাতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
তবে শুধু রাজস্ব আহরণ নয়, এই অর্থ কীভাবে ব্যয় হবে, তাও গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষায়িত ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন তহবিল’, যা ঞযধরঐবধষঃয বা ফিলিপাইনের চযরষঐবধষঃয-এর মতো স্বাধীনভাবে পরিচালিত হবে। এই তহবিলের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, মানসিক স্বাস্থ্য, অসংক্রামক রোধ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্পের মতো খাতগুলোয় টেকসই বিনিয়োগ সম্ভব হবে।
অর্থাৎ বাজেটে সিন ট্যাক্স থেকে আসা আয়ের একটি অংশ কৌশলগতভাবে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা’র ভিত্তি গঠনে ব্যাপক সহায়তা করতে পারে। যদিও তামাকে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ নামে একটা কর আছে, কিন্তু সেটা খুবই কম এবং এই অর্থ ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও অনুপস্থিত।
এবার আসি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের কথায়। এই বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ সামান্য বেড়েছে কিন্তু তা এখনো জাতীয় বাজেটের পাঁচ শতাংশের কাছাকাছিই আছে যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। বাজেটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলাদা কোনো কাঠামোগত সংস্কারের ইঙ্গিত মেলেনি।
সদ্য প্রকাশিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট স্বীকার করে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক আর এখানে শুধু বাজেট বৃদ্ধি নয়, বরং সংস্কার-ভিত্তিক বিনিয়োগও জরুরি।
অথচ সদ্য প্রকাশিত স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট স্বীকার করে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক আর এখানে শুধু বাজেট বৃদ্ধি নয়, বরং সংস্কার-ভিত্তিক বিনিয়োগও জরুরি। সংস্কার কমিশন কয়েকটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছে যা এই বাজেটেই করা যেত। যেমন (১) প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বরাদ্দ বৃদ্ধি, (২) স্বাস্থ্য বিমা চালু বা পাইলট ভিত্তিতে চালু করা, (৩) হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ও তথ্যব্যবস্থায় জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া, ৪) স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করা। আর সিন ট্যাক্স রিফর্ম এই অর্থের জোগান সহজেই দিতে পারতো। যদিও সরকার সেই পথে হাঁটেনি। তবে আশা করা যায় পরবর্তী বাজেটে এই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো দেখা যাবে।
রাজনৈতিক সরকারগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে যেমন ব্যবসায়ী গ্রুপের চাপে অনেক পদক্ষেপ চাইলেও নিতে পারে না। কিন্তু এখন সেই ধরনের চাপ খুব কম। তাই করারোপ সংস্কার করার এখন উপযুক্ত সময়। সিন ট্যাক্সের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ই বেশি হবে না বরং এটি একটি ন্যায্য পদ্ধতি। কারণ এখানে ক্ষতিকর পণ্য ব্যবহারকারী ব্যক্তিও উপকৃত হয় যদি অতিরিক্ত দামের কারণে যদি ব্যবহার কমে যায় এবং সেই অর্থ জনস্বাস্থ্যে পুনর্বিনিয়োগ হয়। এমন ব্যবস্থা দরিদ্রবান্ধব, অর্থনৈতিকভাবে টেকসই এবং ন্যায্যও বটে। অন্য করের বেলায় এসব সুবিধা এক সাথে পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে সিন ট্যাক্স সংস্কারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এরকম পণ্যের ওপর উপযুক্ত করারোপ সময়োপযোগী। তামাক-করকাঠামো সরল করে স্পেসিফিক ও উচ্চ কর আরোপ করা, চিনিযুক্ত পানীয়র ওপর উচ্চহারে কর চালু করা এবং এর থেকে অর্জিত রাজস্ব একটি স্বচ্ছ, স্বাধীন তহবিলে বরাদ্দের মাধ্যমে তা ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি করা সম্ভব। কিন্তু সেটা হবে কী?
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন : :