ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা। আত্মগোপনে থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দারা। সেবা থেকে বঞ্চিত গ্রামের সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যান গঠনের দাবি জানিয়েছেন ইউপি সদস্যরা। এই ইউনিয়নগুলো হলো দরিকান্দি, দরিয়াদৌলত, সোনারামপুর, ফরদাবাদ, রূপসদী ও মানিকপুর।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১ জন চেয়ারম্যানই আত্মগোপনে রয়েছেন। এতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন পরিষদের সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। আর সেই কারণে পলাতক ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণও দাবি করছে জনগণ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাতারাতি গা ঢাকা দেয় বাঞ্ছারামপুরের ১১ জন ইউপি চেয়ারম্যান। এরা হলেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও তেজখালী ইউনিয়নের এ কে এম শহীদুল হক বাবুল, পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নের গাজীউর রহমান, দরিয়াদৌলত ইউনিয়নের এ বি এম মাহবুবুর রহমান উজ্জ্বল, সোনারামপুর ইউনিয়নের শাহিন মিয়া, দরিকান্দি ইউনিয়নের শফিকুল ইসলাম স্বপন, বাঞ্ছারামপুর সদর ইউনিয়নের আবদুর রহিম, ফরদাবাদ ইউনিয়নের রাশিদুল ইসলাম, রূপসদী ইউনিয়নের আবদুল হাকিম, ছলিমাবাদ ইউনিয়নের মো. জালাল মিয়া, উজানচর ইউনিয়নের কাজী জাদিদ আল রহমান জনি ও মানিকপুর ইউনিয়নের মো. ফরিদউদ্দিন।
এদিকে এলাকায় অবস্থান করে নিয়মিত অফিস করে যাচ্ছেন ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের বিনা ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলামের নিকটাত্মীয় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল করিম চৌধুরী ও আইয়ুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম।
বর্তমানে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করছেন। ইউনিয়ন পরিষদগুলো হলো তেজখালী, পাহাড়িয়াকান্দি, বাঞ্ছারামপুর সদর, ছলিমাবাদ ও উজানচর। তাছাড়া প্যানেল চেয়ারম্যান না থাকায় দরিকান্দি, দরিয়াদৌলত, সোনারামপুর, ফরদাবাদ, রূপসদী ও মানিকপুর ইউনিয়নে সেবাকার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
আইন অনুযায়ী জনসেবা অব্যাহত রাখার জন্য তাদের জায়গায় বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক স্ব স্ব অধিক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবেন। প্যানেল চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অথবা যে কোন জটিলতা হলে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করে জনসেবা অব্যাহত রাখবেন। এ নিয়ে সরকার পরিপত্র জারি করেছে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, দেশে কতিপয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বর্তমানে ধারাবাহিকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। যার ফলে ইউনিয়ন পরিষদের জনসেবাসহ সাধারণ কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। উদ্ভূত অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য এ আদেশ জারি করা হলো-
১. অনুপস্থিত চেয়ারম্যানদের কাজ পরিচালনা এবং জনসেবা অব্যাহত রাখার জন্য স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন, ২০০৯-এর ধারা ৩৩, ১০১ এবং ১০২ অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক স্ব স্ব অধিক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যানকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করতে পারবেন।
২। প্যানেল চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে অথবা যে কোন জটিলতা পরিলক্ষিত হলে আইনের ধারা ১০১ ও ১০২ প্রয়োগ করে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক স্ব স্ব অধিক্ষেত্রে তার অধীনস্থ কর্মকর্তা যেমন- উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে সচল রেখে জনসেবা অব্যাহত রাখবেন।
গত ৫ আগস্টের পর বাঞ্ছারামপুরের বেশিরভাগ ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক থাকায় পরিষদের কার্যক্রমে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আইন অনুযায়ী যদি কোন চেয়ারম্যান ৩টি সভায় অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও অপসারণ করার বিধান রয়েছে। এদিকে বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আত্মগোপনে থাকার পরও তাদের ব্যাপারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশাসন ও পলাতক চেয়ারম্যানদের মধ্যে আর্থিক লেনদেন হচ্ছে, এমন অভিযোগ উঠেছে।
বাঞ্ছারামপুরের ১১ জন পলাতক চেয়ারম্যানরা অফিসে না এসেও তাদের ইচ্ছে মতো প্রকল্প দিচ্ছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের স্বাক্ষর সম্বলিত প্রকল্পের নাম সহ রেজুলেশন জমা দিতে হয় উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে। ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত না হয়েও কোন মিটিং না ডেকেই ঢাকায় বসেই শুধুমাত্র রেজুলেশনের স্বাক্ষর করছেন এই সকল পলাতক চেয়ারম্যানরা। প্রতিটি প্রকল্পে রেজুলেশন জমাদান বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে এই সুযোগে চেয়ারম্যানরা মেম্বারদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে তার পছন্দের মেম্বারের মাধ্যমে প্রকল্প দিয়ে কাজ না করে টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ইউনিয়ন উন্নয়ন তহবিলের, ভূমি উন্নয়ন কর ১% এর প্রকল্পে বেশি অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বাঞ্ছারামপুরের পলাতক চেয়ারম্যানরা এলাকায় না আসায় জরুরী কাগজপত্র জন্ম নিবন্ধন, ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, জাতীয় নাগরিক সনদপত্র, ট্রেড লাইসেন্স সহ নানা কাগজ এর জন্য দিনের পর দিন ধর্না দিতে হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে। অনেক ইউনিয়নে সপ্তাহে একদিন ঢাকা থেকে স্বাক্ষর করে এনে কাগজ দেওয়া হয়। এই সকল চেয়ারম্যানরা তাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত লোক দিয়ে এ সকল কাগজ ঢাকায় কিংবা তাদের সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে স্বাক্ষর করে দেন। এতে করে ভোগান্তির চরমে পড়েছে ওই সকল ইউনিয়নে সেবাপ্রত্যাশীরা।
উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও ইতোমধ্যে নানা অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ও সেবাপ্রত্যাশীরা অভিযুক্ত প্যানেল চেয়ারম্যানদেরও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থাগ্রহণের দাবি জানান। ফলে সবকিছু মিলে বাঞ্ছারামপুর ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে সেবা কার্যক্রম অনেকটা বিঘ্নিত হচ্ছে। আর সেই কারণে প্রশাসক অথবা নতুন প্যানেল চেয়ারম্যান দেয়ার দাবি জানান সেবা প্রত্যাশীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনারামপুর ইউনিয়ন পরিষদের জনৈক সেবা প্রত্যাশী বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে শাহিন চেয়ারম্যান পলাতক। তিনি না থাকায় কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে।
রূপসদী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. নাসিরউদ্দিন বলেন, আসলে ইউপি চেয়ারম্যান না থাকলে শতভাগ কাজ করা সম্ভব হয় না। তবে এই ইউনিয়নের মেম্বাররা ভাল, তারা বেশ সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদে আসেন না। তবে মাঝে মধ্যে কাগজপত্রে সই করেন।
এদিকে রূপসদী ইউনিয়নের জনৈক ভুক্তভোগী জানান, চেয়ারম্যান না থাকায় ভোগান্তির শেষ নেই।
দরিয়াদৌলত ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শরীফুল ইসলাম জানান, চেয়ারম্যান না থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদের কাজকর্মে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বাক্ষরের জন্য ঢাকায় যাওয়া হয়। তখন ইউপি চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান স্বাক্ষর করে দেন।
দরিকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মোজাম্মেল হক বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব নিয়মিত না থাকায় কাজকর্মে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ঢাকায় গিয়ে কাগজপত্র স্বাক্ষর করে আনা হয়। সেই কারণে সেবা দিতে দুএকদিন সময় বেশি লাগে। মাঝে মধ্যে এলাকায় আসেন, তখন সমস্যা হয় না। আর আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বদলী হয়ে গেছি। এখানে নতুন সচিব অপু লাল যোগদান করবেন।
মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব লোকমান হোসেনকে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন ইউনিয়নের সেবাপ্রত্যাশী ও ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপ পরিচালক জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আপনার মতামত লিখুন : :