মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী শত শত বিঘা জমি ও বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হলেও থামছে না অবৈধ ড্রেজিং। জেলা প্রশাসন থেকে একস্থান ইজারা দিলেও নির্ধারিত স্থানের বাইরে গিয়ে বালু তুলছেন ঠিকাদার, যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি নেতা। ভাঙন কবলিত স্থান থেকে অবৈধভাবে বালু তুলে দিনে বাণিজ্য হচ্ছে আট লক্ষাধিক টাকার। বিষয়টি এরই মধ্যে নজরে এসেছে জেলা প্রশাসনের।
জানা গেছে, ভাঙনে হরিরামপুর উপজেলার অন্তত ১৩টি মৌজা এরইমধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকিতে রয়েছে উপজেলার নদীরক্ষা বাঁধসহ শতাধিক সরকারি স্থাপনা। আর এই ভাঙনের কারণ হিসেবে পদ্মায় অপরিকল্পিত ড্রেজিংকে দুষছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার পদ্মা নদীর ভাঙন এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী মহল। প্রতিদিন ৭-৮টি ড্রেজার থেকে প্রায় ৮ লাখ টাকার বাণিজ্য করছে চক্রটি। এই বালু উত্তোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল হান্নান মৃধা ও সাবেক এক ছাত্রদল নেতা। নিরাপত্তা হিসেবে রাখা হয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী।
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরে গত ৭ মে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে হরিরামপুর উপজেলার লেছড়াগঞ্জ বালুমহালের ইজারা নেয় ফরিদপুর জেলার মিথিলা এন্টারপ্রাইজ। গত ২৯ মে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বালুমহালের নির্ধারিত সীমানা এবং দখল বুঝিয়ে দিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসিল্যান্ডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের সাফায়েত হোসেন বলেন, নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু কাইটা নিয়া যায়। ওই কারণেই আমাদের এই পাড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। শুনলাম এইখানে বস্তা ফালাইবো, এর কোনো কিছুই দেখলাম না। এই নদী ভাঙনের মূল কারণ ওই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন। আমরা বারণ করলে শুনেও না। এর আগে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার দুইদিন পরে আবার বালু উত্তোলন শুরু করেছে।
উপজেলার সুতালড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আঁখি আক্তার বলেন, এই নদী আমাদের ঘড়বাড়ি সব নিয়ে গেছে। এখন আমাদের আর কিছুই নেই। আমরা পরিবারসহ সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে থাকি।
আজিমনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাগো চরের মানুষকে কেউ মানুষ মনে করে না। যারা সরকারি চাকরি করে তারা যদি কেউ আমাগো মানুষ মনে করতো, তাইলে এই পদ্মাকে ঠেকিয়ে দিত। গেলো বছরও দুইশ বিঘার বেশি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ বছরও ভাঙন শুরু হয়েছে। পুরোপুরি বর্ষা শুরু হলে আমাদের থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে। সরকারের যদি দয়া হয় আমাদের প্রতি তাহলে বাঁধ দিয়ে দিবে। না হলে আমাদের কিছু করার নাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, নির্ধারিত বালু মহালের সীমানা অতিক্রম করে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্বে এসে হরিরামপুর উপজেলার বয়ড়া ইউনিয়নে দিনে-দুপুরে অন্তত ১০টি ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করছে মিথিলা এন্টারপ্রাইজ। স্থানীয় প্রভাবশালী বিএনপির নেতাদের দাপটে প্রকাশ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ইজারাদার অধিক মুনাফার আশায় নির্ধারিত বালুমহালের বাইরে এসে বালু উত্তোলন করছেন। কারণ ইজারাকৃত স্থানে রয়েছে ভিটি বালু। যার প্রতি বর্গফুটের দাম ৫০ পয়সা থেকে ১ টাকা। ইজারাবহির্ভূত স্থানে রয়েছে কনস্ট্রাকশন বালু। যার বর্গফুটের দাম ২ টাকা থেকে ৩ টাকা। ইজারাদার নিজের পকেট ভারী করতে ইজারাকৃত স্থান রেখে নদীভাঙন কবলিত স্থানে এসে বালু উত্তোলন করছেন।
বালু মহালে বালু কাটার মেশিনের শ্রমিক (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, আগে একটু বেশি বাণিজ্য হতো। এখন মাঝে মধ্যে সেনাবাহিনী আসে। আজ সাতটি ড্রেজার চলছে। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ স্কয়ার ফিট বালু উত্তোলন করা যায়। এতে আনুমানিক সাত থেকে আট লাখ টাকার বাণিজ্য হয়।
রাজু দেওয়ান বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে বালু মহালের হিসাব রাখা। তারা শেয়ার হোল্ডার। বেসিক্যালি কো-অর্ডিনেট করেন হান্নান মৃধা। মাঝে মধ্যে হিসাব নিতে হান্নান মৃধা, মিজানুর রহমান ও মোশারফ হোসেন আসেন হিসাব নিতে। কীভাবে কী করতে হবে আমাদের বলে যান।
এ বিষয়ে হরিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল হান্নান মৃধা বলেন, আমি বালু ব্যবসার সঙ্গে নাই। আমাদের লোকজন আছে, ১০০ শেয়ার কিনেছে। বৈধ বালু মহালের শেয়ার কিনে ব্যাবসা করছে। প্রশাসনের ইজারাকৃত নির্ধারিত জায়গার বাহিরে গিয়ে বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। এটা প্রশাসন দেখবে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিথিলা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. আলমগীর হোসেন জানান, নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয় বিএনপির নেতাদের কাছে বালু মহালের শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে আমরা যে বালু মহাল ইজারা দিয়েছি তার নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে গিয়ে ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এ ধরনের কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধ। এর বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। থানায় নিয়মিত মামলাও দায়ের করছি। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করেছি। এই অভিযান চালবে। আরও কঠোরভাবে এই বিষয়গুলো দমন করবো।
আপনার মতামত লিখুন : :