জামালপুর সদরসহ ৭ উপজেলাতেই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন চটকদার নামে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসবের মধ্যে জেলা শহরের বেশ কিছুর অনুমোদন থাকলেও অধিকাংশ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে অবৈধভাবে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। অধিকাংশ হাসপাতালের নেই জরুরি বিভাগ, নেই রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট। ধার করা অস্থায়ী চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অস্ত্রোপচারসহ নানা চিকিৎসা। স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় অনুমোদনপ্রাপ্ত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা শতাধিক। বাস্তবে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের বেশি।
জানা গেছে, জেলা শহর ছাড়াও উপজেলার অলিগলিতে চোখে পড়ে নামি-দামি চিকিৎসকদের নাম সংবলিত ব্যানারসহ ডিজিটাল সাইনবোর্ড। এসব হাসপাতালের রয়েছে নিজস্ব দালাল চক্র। দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাম-গঞ্জের মানুষ।
সরেজমিন জানা গেছে, জেলা শহরে হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নেই ৩ বছর ধরে। ফলে অপচিকিৎসা কম্পিউটারাইজড পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ও অত্যাধুনিক নামে সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব হাসপাতালে গিয়ে অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। অকালে ঝরছে অনেকের প্রাণ।
ভুক্তভোগীরা জানান, গত ৫ জুলাই জামালপুর পৌরসভার পরিচালিত নগর মাতৃসদনে প্রসব করাতে গিয়ে নার্স ও আয়ার অস্ত্রোপচারে মৃত্যু হয় নবজাতকের। চিকিৎসক ছাড়াই অস্ত্রোপচার করায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রসূতির জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে প্রাণে বেঁচে যান ওই প্রসূতি। এ ঘটনায় জামালপুর থানায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। পুলিশ ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স ও আয়াকে গ্রেপ্তার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে প্রকৃত অপরাধীরা।
গত ২৬ মে চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে দিকপাইত এলাকার দুবাই বেসরকারি হাসপাতালে রিতু নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। অস্ত্রোপচারের পর রাতে প্রসূতির শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় রাতভর যন্ত্রণায় ছটফট করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রিতু। ঘটনার পর হাসপাতালটির অপারেশন থিয়েটার সিলগালা করে দেয় স্বাস্থ্য বিভাগ। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটির তদন্তেও হাসপাতালটির নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ে। এরপরও হাসপাতালটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। অদৃশ্য শক্তির বলে হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে পুরোদমে।
এর আগে গত বছরের ১ নভেম্বর জামালপুর শহরের এম এ রশিদ হাসপাতালে সন্তান জন্মের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় গৃহবধূ হাসি খাতুনের। সিজারের সময় নাড়ি কেটে ফেলায় মারা যান এই প্রসূতি।
একই বছরের ১৩ নভেম্বর শহরের নকীব উদ্দীন হাসপাতালে সন্তান প্রসব করতে যান গৃহবধূ রুম্পা বেগম। চিকিৎসক না থাকায় ওয়ার্ডবয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিলে রুম্পার সন্তান প্রসব করান। এ সময় প্রসূতির পেটে অপরিকল্পিতভাবে প্রচণ্ড চাপ প্রয়োগ করায় খুলি ভেঙে মারা যায় শিশুটি।
সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, জামালপুর সদরে ৫০টি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে ২৮টি, মেলান্দহে ৫টির মধ্যে ৪টি, মাদারগঞ্জে ৩টির মধ্যে ২টি, সরিষাবাড়ীতে ৪টির মধ্যে ২টি, ইসলামপুরে ২টি, দেওয়ানগঞ্জে ২টি, বকশীগঞ্জে ২টি হাসপাতালের লাইলেন্সের মেয়াদ ছিল ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত। এরপর থেকে এসব হাসপাতাল চলছে স্বাস্থ্য বিভাগের লাইন্সেস ছাড়াই।
অপরদিকে জামালপুর সদরের ৬৫টি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও প্যাথলজি সেন্টারের মধ্যে ৪৩টি, মেলান্দহে ৯টির মধ্যে ৭টি, ইসলামপুরে ৮টির মধ্যে ৬টি, মাদারগঞ্জে ৯টির মধ্যে ৬টি, সরিষাবাড়ীতে ২০টির মধ্যে ১৯টি, বকশীগঞ্জে ১৫টির মধ্যে ১৩টি ও দেওয়ানগঞ্জে ৮টি ৩ বছর ধরে চলছে অবৈধভাবে।
জামালপুর শহরের দড়িপাড়া বাইপাস মোড়ের দি রেঁনেসা জেনারেল হাসপাতাল ও সরিষাবাড়ী উপজেলার হিউম্যান ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক আবুল কালাম আজাদ। তিনি একজন এমবিবিএস ডাক্তার। তিনি কীভাবে ৩ বছর ধরে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনা করে আসছেন জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। শুধু বলেন, লাইসেন্সের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মেলান্দহ উপজেলার মালঞ্চ এলাকার ১০ শয্যার এম এ রশিদ জেনারেল হসপিটালের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত। এরপর থেকে চলছে অবৈধভাবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, ভাড়া করা অস্থায়ী চিকিৎসক দিয়ে অস্ত্রোপচার করানোর কারণে কেউ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ঘটেছে প্রাণহানিও। প্রশাসনের নাকের ডগায় অনুমোদনহীন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিনিয়ত রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করলেও স্বাস্থ্য বিভাগ সবকিছু জেনেও অজ্ঞাত কারণে নীরব।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিমের ভাষ্য, হাসপাতালের নামে যারা মরণ ফাঁদ পেতে বসেছেন, তাদের বিরুদ্ধে জরুরি ব্যবস্থা না নিলে অপচিকিৎসায় প্রাণ ঝরতেই থাকবে।
সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল হক বলেন, লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন : :