ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন পরিষদের বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও অসদাচরণের অভিযোগ ছিল। বিনা ভোটে নির্বাচিত এসব চেয়ারম্যানদের উপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল সাধারণ মানুষ। বিগত সময়ে সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের আস্কারায় তার ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানের একক আধিপত্যের কারণে নানাবিধ অন্যায় অত্যাচার সহ্য করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নীরিহ মানুষ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উপজেলার প্রায় সব চেয়ারম্যানই গা ঢাকা দেয়। ফলে নতুন করে নানাবিধ সমস্যায় পড়ে সেবাপ্রত্যাশীরা।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে বেশির ভাগ চেয়ারম্যানই বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়। ওই নির্বাচনে সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ও তার ভাগিনা জনি চেয়ারম্যান কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা হলেন পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নে গাজীউর রহমান, সোনারামপুর ইউনিয়নে মো. শাহিন মিয়া, দরিকান্দি ইউনিয়নে শফিকুল ইসলাম স্বপন, ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নে আবদুল করিম, বাঞ্ছারামপুর সদর ইউনিয়নে আবদুর রহিম, ফরদাবাদ ইউনিয়নে রাশিদুল ইসলাম, রূপসদী ইউনিয়নে আবদুল হাকিম, ছলিমাবাদ ইউনিয়নে মো. জালাল মিয়া, উজানচর ইউনিয়নের কাজী জাদিদ আল রহমান জনি এবং মানিকপুর ইউনিয়নে মো. ফরিদউদ্দিন।
অন্যদিকে তেজখালী ও দরিয়াদৌলত ইউনিয়নে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম শহীদুল হক বাবুল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মাহবুবুল হক উজ্জ্বলকে বিজয়ী করার অভিযোগ রয়েছে। ওই নির্বাচনে সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ও এমপির ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে ফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ করেছিলেন তেজখালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী ফাইজুর রহমান ফাজিল ও দরিয়াদৌলত ইউনিয়নের প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী এ্যাডভোকেট জিয়াউল হক বাদল। আর সেই কারণে নানাভাবে বিতর্কিত বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যানদের প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটি হারিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া নির্বাচিত হওয়ার পরপরই উপজেলার বেশির ভাগ ইউপি চেয়ারম্যানদের সীমাহিন অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে জনগণ চরমভাবে অতিষ্ঠ ছিল। সরকারি নানা প্রকল্পের টাকা হরিলুট হয়েছে, যা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
গত ১১ মাস যাবত বাঞ্ছারামপুরের ইউপি চেয়ারম্যানরা পালিয়ে থাকলেও কৌশলে সরকারি সুযোগ সুবিধা সবই ভোগ করে যাচ্ছেন। কয়েকজন চেয়ারম্যান ইউপি সচিবকে ম্যানেজ করে ট্যাক্সের টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া অনেক প্রকল্পের নামে সরকারি টাকা লুট করেছে। আর সেই কারণেই বাঞ্ছারামপুরের চিহ্নিত চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে তদন্তের দাবি জানান সচেতন মহল।
এদিকে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের সবগুলোতেই ইউনিয়ন পরিষদ তথা নিজস্ব অফিস রয়েছে। তারপরও বিতর্কিত চেয়ারম্যানরা সাধারণ মানুষের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে অফিসের বারান্দায় গুটিকয়েক মেম্বার, গ্রাম পুলিশ ও সেবাপ্রত্যাশীদের আনাগোনা থাকে। সচিবদের অনেকেই অলস সময় কাটায়। চেয়ারম্যান না থাকায় পরিষদের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে।
পরিষদে সেবা নিতে আসা অনেকেই জানান, ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্সে, জন্ম নিবন্ধন, চারিত্রিক সনদপত্র, ভূমিহীন সনদপত্র, ওয়ারিশান সনদপত্র, অবিবাহিত সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র, অস্বচ্ছল প্রত্যয়নপত্র, নাগরিক সনদপত্র, উত্তরাধিকার সনদপত্র এসব সেবা থেকে বঞ্চিত ইউনিয়নবাসী। অনেকেই পরিষদে ঘুরছেন স্বাক্ষরের জন্য, কিন্তু চেয়ারম্যান না থাকায় প্রতিদিনই ফিরে যাচ্ছেন। অথচ নানা প্রকল্পের টাকা ঠিকই হরিলুট হচ্ছে। তাছাড়া কর্মস্থলে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকা বাঞ্ছারামপুরের ইউপি চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে কার্যত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতির বিষয়ে অন্তর্বতী সরকারের জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়, দেশের যেকোনো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে জনসাধারণের সেবাকাজ বিঘ্নিত হলে সেখানে বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসকরা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত প্যানেল চেয়ারম্যানদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পণ করবেন। আর প্যানেল চেয়ারম্যানরাও অনুপস্থিত থাকলে সেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এসব ক্ষমতা অর্পণ করবেন। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে বিতর্কিত প্যানেল চেয়ারম্যান থাকায় সেবাপ্রত্যাশীদের র্দুভোগ আরও বেড়ে যায়।
এদিকে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপি জামায়াতের একাধিক নেতা উপজেলার বিতর্কিত, বিনা ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের অপসারণের দাবি জানান।
এ বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারের সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবু আলম শহীদ খান বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এমন সব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, নির্বাচন নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে, হতাশা রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে মানুষ এখন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। বিনা ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান সহ বিতর্কিত চেয়ারম্যানদের তারা অপসারণ চাইছে। এটা বাস্তবায়ন করা বর্তমান সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান সরকার অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যেমনটি করেছে, ঠিক একইভাবে ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাছাড়া বিনা ভোটে নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে জোর তদন্ত হওয়া উচিত। অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের সাথে ভোট ছাড়া নির্বাচিত চেয়ারম্যানরাই সাধারণত জড়িত থাকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া বলেন, বিগত সময়ে ক্ষমতার জোরে অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করা হবে। তাছাড়া যারা আধিপত্য বিস্তার করে বিজয়ী হয়েছেন তাদের ব্যাপারেও তদন্ত চলছে। কোন ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম পেলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
বাঞ্ছারামপুরের ১৩জন চেয়ারম্যানের মধ্যে ১১ জনই আত্মগোপনে চলে গেছে। কেউ এলাকায় পালিয়ে থাকলেও দপ্তরে আসছে না। আর সেই কারণেই বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া বর্তমান ইউএনও ফেরদৌস আরা একাই ভূমি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেকগুলো অফিসের কাজ করছেন। নিঃসন্দেহে এটা বাড়তি চাপ। তারপরও বাঞ্ছারামপুরবাসী উপজেলার বিতর্কিত চেয়ারম্যানদের ব্যাপারে ইউএনওসহ, উপ পরিচালক জেলা স্থানীয় সরকার, জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আপনার মতামত লিখুন : :