কুমিল্লার চান্দিনায় জমি রেজিস্ট্রিতে সরকারি নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জমির দলিল করতে আসা অধিকাংশরাই জানেন না পৌরসভা, ইউনিয়ন ভিত্তিক জমির কোন শ্রেণিতে কত টাকা দলিল খরচ। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছেমত ফি নির্ধারণ করে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলিল লিখকরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিকাংশ দলিলে কাগজপত্রের অসংগতি দেখিয়ে ‘স্যারের সঙ্গে কন্ট্রাক করে দলিল করতে হবে’ এমন অযুহাতে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণ টাকা। টাকা-পয়সার বনিবনা ঠিক হলে ভুয়া কাগজপত্রেও জমি রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে ওই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে! এতে একদিকে যেমন সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে অপরদিকে জমির প্রকৃত মালিকরা ভূমি দস্যুদের কবলে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
চান্দিনা উপজেলার হারং গ্রামের বাসিন্দা লুৎফা আক্তার তার পৈত্রিক ওয়ারিশকৃত ২৪ শতাংশ সম্পত্তির অংশ বিক্রি করবেন। ইসলামী ফারায়াজ মোতাবেক দুই ভাই ও এক বোন হিসেবে তিনি ৪.৮ শতাংশ জমির মালিক হন। কিন্তু তিনি বিক্রি করতে চান ৮ শতাংশ সম্পত্তি।
চান্দিনা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের হারুন নামের এক দলিল লেখকের কাছে যান তিনি। নারীর এক ভাইকে বাদ দিয়ে ভুয়া ওয়ারিশ সনদ এবং একটি নামজারি খারিজ খতিয়ান ও ভুয়া দাখিলা তৈরি করে চলতি বছরের আগস্ট মাসের ১২ তারিখে ৮ শতাংশ সম্পত্তির দলিল সম্পন্ন করেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ৮ শতাংশ জমির সরকারি নির্ধারিত ফি ৭২ হাজার টাকা হলেও তার পরিবর্তে নেওয়া হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। জমির ক্রেতা পারভীন আক্তার ওই দলিল মূলে নিজ নামে নামজারি করার আবেদন করার পর ভুয়া কাগজপত্র ধরা পড়ে পৌরসভার উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তার হাতে।
বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চান্দিনা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার উপজেলা ভূমি অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে জমি বিক্রেতা লুৎফার নামে নতুন একটি দাখিলা তৈরি করে এক মাস পর ওই কপি দলিলের সঙ্গে যুক্ত করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লুৎফা আক্তারের মতো প্রতিদিন এমন বহু ভুয়া দলিল করা হচ্ছে চান্দিনা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। এসব কাজ করানোর জন্য দলিল লিখকের আড়ালে কয়েকজন দালাল রয়েছে। তারা টাকার বিনিময়ে সাব রেজিস্ট্রার ও অফিস সহকারীর সাথে চুক্তি করে এসব দলিল করছেন। জমির ক্রেতা ও বিক্রেতাদের অভিযোগ, চান্দিনা পৌর এলাকায় সাধারণত জমির মোট মূল্যের সাড়ে ৭ শতাংশ সরকারি ফি।
দলিল লিখকরা সরকারের নির্ধারিত ‘ফি সাড়ে ৭ শতাংশের স্থলে সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ ফি নিচ্ছে। আবার কাগজপত্রের নানা অসংগতি দেখিয়ে ‘স্যার ও অফিস ম্যানেজ’ এর নাম ভাঙিয়ে কখনও ১২ থেকে ১৫ শতাংশ টাকাও হাতিয়ে দিচ্ছে দলিল লেখকরা। ওই টাকার বিশাল একটি অংশ যায় সাব রেজিস্ট্রারের পকেটে।
উপজেলার মাইজখার গ্রামের বাসিন্দা সাঈদ জানান, আমার এক আত্মীয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে একটি দলিল করেছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে নাল সম্পত্তি সাড়ে ৫ শতাংশ সরকারি ফি হলেও তাকে ৯ শতাংশ টাকা ফি দিয়ে দলিল করতে হয়েছে। কত টাকার ব্যাংক রসিদ কাটা হয়েছে সেই রসিদও জমি ক্রেতার হাতে দেননি দলিল লেখক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক দলিল লেখক জানান, সরকারি নির্ধারিত সাড়ে ৭ শতাংশ ফি হলেও দেড় শতাংশ ফি সাব রেজিস্ট্রার ও অফিস খরচ দিতে হয়। ২০ লাখ টাকা মূল্যের একটি দলিলে সরকারি ফি আসে দেড় লক্ষ টাকা এবং ওই দলিল হচ্ছে কমপক্ষে ২ লক্ষ টাকায়। প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০-৭০টি দলিল হচ্ছে। সেই হিসেবে টাকার পরিমাণ কোথায় দাঁড়ায়? প্রতিদিন কমপক্ষ ৪-৫ লক্ষ টাকা নিচ্ছেন সাব-রেজিস্ট্রার।
দলিল লেখকরা আরো বলেন, টাকা শুধু যে দলিল লেখকরাই নেন এমন না। দলিল লিখে সাব-রেজিস্ট্রারের হাতে দেওয়ার আগে অফিস সহকারী দলিলটি যাচাই করেন। এ সময় তাকে ২০০ টাকা দিতে হয়। কাগজপত্রে টুকিটাকি ত্রুটি থাকলে টাকার অংক বাড়ে। তখন অফিস সহকারীর সঙ্গে চুক্তি করে করতে হয়। আবার দলিল সম্পন্ন হলে দলিল দাতা যে কাগজে হাতের টিপসই দেন সেখানেও ১০০ টাকা দিতে হয়।
চান্দিনা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সরকার অনুমোদিত ৭০ জন দলিল লেখকের বাইরেও অন্তত অর্ধশত ভুয়া দলিল লেখক অবস্থান করেন। জমি ক্রেতা বা বিক্রেতাদের অধিকাংশরাই জানেন না ওই দলিল লেখকদের মাঝে কার সরকারি সনদ আছে, বা কার নেই।
সেবা পেতে হলে এই ‘অফিস খরচ’ না দিলে কার্যক্রম আটকে থাকে দিনের পর দিন। কেউ প্রশ্ন তুললে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এসব দালালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে অফিস সহকারী থেকে শুরু করে সাব-রেজিস্ট্রার পর্যন্ত।
উপজেলার তাজুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘এই দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালরা মিলেমিশে একটি দুর্নীতির চক্র গড়ে তুলেছে। এই চিত্র শুধু এখন নয়, এটা যুগের পর যুগ হয়ে আসছে। ভুক্তভোগীরা একাধিকবার অভিযোগ করলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চান্দিনা সাব-রেজিস্ট্রার মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, হারং গ্রামের ওই নারীর দলিল করার আমরা স্ক্যান করে সব সঠিক পাই। পরবর্তীতে জানতে পারি ওই কাগজটি জাল ছিল। তা কিভাবে হয়েছে, সেটা আমি জানি না।
দলিল খরচে অতিরিক্ত ফি নেওয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি অফিসের সামনে দলিল খরচের চার্ট টানিয়ে রেখেছি, কেউ যদি বেশি টাকায় দলিল করে এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।
আপনাকে ও আপনার অফিস খরচ দেড় শতাংশ দিতে হয় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা। এসবের কোনো প্রমাণ নেই।
আপনার মতামত লিখুন : :