ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশকে নিরাপদ দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর মানে, এই দেশগুলোর নাগরিকেরা ইউরোপে আশ্রয় দাবি করলে তাদের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। যার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান হচ্ছে। এতে করে বাংলাদেশিদের জন্য আশ্রয় প্রক্রিয়া আগের চেয়ে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ইইউর প্রস্তাবিত নিরাপদ দেশের তালিকার লক্ষ্য হলো, নিরাপদ দেশগুলোর নাগরিকদের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। কিন্তু শুধু কি নিরাপদ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির কারণেই বাংলাদেশের নাগরিকদের আশ্রয়ের আবেদন বাতিল বা প্রত্যাখাত হচ্ছে। না কি আরও অনেক কারণ রয়েছে। এমন প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপের প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে।
এ বিষয়ে ফ্রান্স প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও মাইগ্রেন্টওয়াচ সম্পাদক নিয়াজ মাহমুদ বলেন, ইউরোপের দেশগুলো একে একে যখন বাংলাদেশকে নিরাপদ বলে ঘোষণা দিচ্ছে, তখন আমাদের ভেতরে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক এটা কি রাজনৈতিক স্বীকৃতি, নাকি আমাদের অভিবাসীদের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের এক কৌশলী বার্তা?
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশি প্রবাসীদের একাংশের কর্মকাণ্ড ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা স্পেনে মানুষের মনে বিরক্তি ও অবিশ্বাস জন্ম দিয়েছে। ট্যাক্স ফাঁকি, ভুয়া ব্যবসা, বিমা প্রতারণা থেকে শুরু করে ভুয়া ডকুমেন্ট দিয়ে আশ্রয় আবেদন সবই ইউরোপীয় সমাজে আমাদের চিত্রকে কলঙ্কিত করেছে। আর এই ভুয়া গল্পগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, প্রকৃত ভিকটিম বা সত্যিকার নির্যাতিত মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে মিথ্যার ভিড়ে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, এখন একজন সত্যিকার রাজনৈতিক ভিকটিম, সংখ্যালঘু নাগরিক বা নির্যাতিত সাংবাদিক আশ্রয়ের সঠিক নথি বা প্রমাণ নিয়ে আসতেও হিমশিম খাচ্ছেন।
অন্যদিকে অসংখ্য সুযোগসন্ধানী লোকজন ভুয়া গল্প বানিয়ে নিজেদের ভিকটিম সাজাতে ব্যস্ত। এ যেন এক ধরনের ভিকটিম ইন্ডাস্ট্রি। যা শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, প্রবাস জীবনে পরিশ্রম করে সৎভাবে টিকে থাকা লাখো বাংলাদেশির সংগ্রামকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা জ্যেষ্ঠ এ প্রবাসী সাংবাদিক মনে করেন, ইউরোপের নজরে বাংলাদেশকে নিরাপদ বলা মানে আশ্রয় প্রার্থনার সেই ভুয়া দরজাগুলো একে একে বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু সেই সাথে এ ঘোষণার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রবাসী সমাজকে একটি সতর্কসংকেতও দেওয়া হচ্ছে। তা হলো, আপনারা নিজেদের আচরণ ও কর্মকাণ্ড দিয়ে ইউরোপের আস্থা হারাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, আজ আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, নিজেদের ভেতরে আত্মসমালোচনা করা। মনে রাখতে হবে, আমরা প্রত্যেকেই দেশের অঘোষিত রাষ্ট্রদূত। আমাদের কর্মকাণ্ডই ঠিক করে দেয়, আগামী দিনে ইউরোপে বাংলাদেশির পরিচয় হবে, বিশ্বাসযোগ্য ও পরিশ্রমী অভিবাসী নাকি ভুয়া গল্পের কারিগর? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের হাতেই।
তবে আশার কথা হচ্ছে, আশ্রয়ের দাবিতে এসব আবেদন প্রত্যাখান হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা বাতিল হয় না। ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আদালত আগস্টে বলেছে, বাংলাদেশকে নিরাপদ ঘোষণা করা হলেও ব্যক্তিগত ঝুঁকি বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকলে প্রত্যেক মামলার আলাদা বিচার হবে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এই রায়ের ফলে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের মতো করে আবেদন করতে পারবে। তবে, এই আবেদন শুরুতেই প্রত্যাখানের হার এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।
ইইউ সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্সের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অবৈধ পথে প্রায় ১ লাখ অভিবাসীর প্রবেশ নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকরা শীর্ষে রয়েছে।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, শুধু জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে পৌঁছেছেন অন্তত ৮ হাজার বাংলাদেশি। ইউরোপে পৌঁছার পর বাংলাদেশিরা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এরপর করেন আশ্রয়ের আবেদন।
ইতালি প্রবাসী জাতীয় নাগরিক পার্টির সংগঠক মুজাদ্দেদ আল মামুন বলেন, প্রতিনিয়ত ইতালিতে নতুন নতুন বাংলাদেশি অভিবাসীরা আসছেন। তবে এখন আশ্রয়ের আবেদন প্রথম ধাপে অধিকাংশেরই বাতিল হচ্ছে। ইতালিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপেও আপিলের সুযোগ রয়েছে। অনেকের তৃতীয় ধাপেও আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ হচ্ছে। ইতালিতে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এখানে কাউকে জোর করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় না।
একই কথা বলেন পর্তুগাল প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ রিফাত শিকদার। তিনি বলেন, একটা সময় পর্তুগালে সহজেই আশ্রয়ের আবেদন গ্রহণ করা হতো। এখন নতুন নিয়মানুসারে তা কঠিন হয়ে গেছে। তবে, ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তি বিবেচনায় অনেকের আশ্রয় আবেদন গ্রহণও হচ্ছে।
বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব এখনো ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মত অনুমোদন পায়নি। তবে কার্যকর হলে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন দ্রুত প্রত্যাখ্যান ও দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া সহজ হবে।
আপনার মতামত লিখুন : :