ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের হাট বাজারসহ অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেশিরভাগ ওষুধের ফার্মেসির নেই ড্রাগ লাইসেন্স। এসমস্ত ফার্মেসিতে নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র এবং প্রশিক্ষিত ফার্মাসিষ্ট ব্যতীত জীবন রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ ওষুধসহ অ্যান্টিবায়োটিকও বিক্রি করা হচ্ছে অবৈধভাবে। ফলে জনগণ রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
বিশেষ করে অভাবী ও নিম্নবিত্ত লোকজনকে বেশিরভাগ ওষুধ দোকানি নিজেরাই ডাক্তারের মতো অহরহ চিকিৎসা করছে। ওষুধ প্রশাসনের নীতিমালা মোতাবেক বৈধ ফার্মেসির প্রত্যেকটিতে ওষুধ বিক্রি করার জন্য প্রশিক্ষিত ফার্মাসিষ্ট থাকতে হবে। কিন্তু উপজেলার এসব দোকানে এ ধরণের নিয়ম নীতির কোনো বালাই নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নিয়মিত কঠোর মনিটরিং এবং বিশেষ অভিযানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা জরুরী বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকগণ। প্রশাসনের সঠিক নজরদারি না থাকায় ড্রাগ লাইসেন্স, কেমিস্ট ও ফার্মাসিস্ট ছাড়াই শুধুমাত্র ইউনিয়ন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই গড়ে উঠেছে ওষুধের দোকান।
জনসাধারণের জন্য ওষুধ পাওয়া এবং ওষুধের যৌক্তিক ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি করতে সরকারীভাবে ফার্মেসি এবং ওষুধের দোকান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য একটি নির্দেশিকা রয়েছে। ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী মডেল ফার্মেসিতে (লেভেল-১) কমপক্ষে একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী ফার্মাসিস্ট থাকবেন, তাকে সাহায্য করবেন বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট কাউন্সিল থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ফার্মাসিস্ট।
আর মডেল মেডিসিন শপে (লেভেল-২) থাকবেন কমপক্ষে ডিপ্লোমাধারী ফার্মাসিস্ট। বাংলাদেশ কাউন্সিল থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ফার্মাসিস্ট তাকে সহায়তা করবেন। প্রশিক্ষণ নেই এমন কেউ ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে ওষুধ বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবে না এমন কঠোর নির্দেশনাও রয়েছে। এই অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওষুধ প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন উপজেলার সচেতন মহল।
রেজিস্টার চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপসন) ছাড়াই মাদকাসক্তরা চাওয়া মাত্রই অনেক ফার্মেসিতে বিক্রি করছে নেশা জাতীয় বিভিন্ন ওষুধ। এসব ফার্মেসির বেশীর ভাগেরই নেই কোন ফার্মাসিস্ট অভিজ্ঞতা সনদ। নেই ড্রাগ লাইসেন্স। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন গড়ে উঠছে শতশত ফার্মেসি। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে মালিক ও কর্মচারীরাই ডাক্তারী করছে। আর প্রতারিত হচ্ছে অসহায় সাধারণ মানুষজন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামে, মোড়ে, বাজারে অবৈধ ফার্মেসী ব্যবসা হয়ে উঠেছে জমজমাট। এসব দেখার কেউ নেই। এতে হুমকিতে পড়েছে এই অঞ্চলের জনস্বাস্থ্য। এছাড়াও অনেক মুদি ও মনোহারি দোকানেও অবাধে বিক্রি হচ্ছে উচ্চ মাত্রার এন্টিবায়োটি, ব্যথা নাশক, যৌন উত্তেজক ঔষধ সহ নানা রকম নিম্নমানের ওষুধ। ফলে তৈরি হচ্ছে বড় ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। অথচ এসব বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে দেখা গেছে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছোট বড় গ্রাম ও হাট বাজারে বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৫ শতাধিক লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি। যার অধিকাংশের কোন বৈধ কাগজপত্র নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দেয়া গুটি কয়েক লাইসেন্সধারী ফার্মেসি রয়েছে, আর কিছু কিছু ফার্মেসির লাইসেন্স থাকলেও দীর্ঘদিন থেকে হয়নি লাইসেন্স নবায়ন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বিভিন্ন ফার্মেসি ঘুরে দেখা যায়, ঔষধ প্রশাসনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে শুধু ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অনেকেই ফার্মেসি দিয়ে বসে পড়েছেন ঔষধ বিক্রির জন্য। আর কয়েকটি ফার্মেসিতে ড্রাগ সুপারের কার্যালয় থেকে একটা নির্দেশনা ও রয়েছে। যার মধ্যে লেখা রয়েছে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টি বায়োটিক ঔষধ বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু এই নির্দেশনাও মানছে না কেউ। যাদের কোন প্রশিক্ষণ বা অনুমতি নেই, তারাই দিচ্ছে উচ্চ মাত্রায় এন্টিবায়োটিক, উল্টা পাল্টা বুঝিয়ে দিচ্ছে নিম্নমানের ঔষুধ। যার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, এসব ফার্মেসির অধিকাংশই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের বাইরে ঔষধ সরবরাহ করে থাকেন এবং রোগীদের বলে থাকেন একই গ্রুপের ঔষুধ ডাক্তার যেটা লিখেছেন তার চেয়েও ভাল। ফলে রোগীরা সরল বিশ্বাসে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। অবৈধ এসব ফার্মেসিতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক, ঘুমের বড়ি ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, নিষিদ্ধ ভারতীয় নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের নানা প্রকার ওষুধ অবাধে বিক্রি হয়ে আসছে। ফলে একদিকে যেমন ওষুধ ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি ঘটছে নানা ধরনের ছোট বড় দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে মানুষজন। এতে আর্থিক, শারিরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক রোগী ও তাদের পরিবার পরিজন।
বাঞ্ছারামপুরে বেশিরভাগ ফার্মেসির মালিকরাও ভুয়া ডাক্তার সেজে বসে আছেন। উপজেলার গরীব নিরীহ মানুষ ছোট খাট অসুখে অনেক সময় সুচিকিৎসা লাভের আশায় কখনও ভিজিটের ভয়ে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের কাছে না গিয়ে সরাসরি ফার্মেসিতে গিয়ে রোগের বর্ণনা দিয়ে ওষুধ চান। আর এসব নামধারী ডাক্তারদের দেয়া উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রয়োগের ফলে বিপরীত ফল হয় প্রতিনিয়তই। আবার দেখা যায়, এলোপ্যাথিক ঔষধের ফার্মেসিতে পশুর ঔষধ।
এদিকে লাইসেন্সবিহীন এলোপ্যাথিক ঔষধের পাশাপাশি আবার পশু, আয়ুর্বেদীক ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ফার্মেসি খুলে বসেছে অনেকে। ইউনানীর নামে হরমোন ও বিভিন্ন মানহীন বোতলজাত ঔষধ বিক্রি হচ্ছে দেদারছে।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানজনক ব্যবসার মধ্যে ফার্মেসি ব্যবসা অন্যতম। এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করে সহজেই লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর সেই কারণেই অনেকে একটা দোকানে কিছু ওষুধ নিয়ে বসে পড়ে। অথচ এই ব্যবসা করতে হলে আনুসঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সাথে আরও অতিরিক্ত করতে হবে ফার্মাসিস্টের ট্রেনিং এবং ড্রাগ লাইসেন্স। ওষুধ তিনিই বিক্রি করতে পারবে যার ফার্মাসিস্ট ট্রেনিং আছে এবং যিনি ড্রাগ লাইসেন্স পেয়েছেন। ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধের ব্যবসা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং আইনগতভাবে এটি একটি দন্ডনীয় অপরাধ। আর ওষুধ ব্যবসার জন্যে অতি প্রয়োজনীয় এই ড্রাগ লাইসেন্সটি ইস্যু করে বাংলাদেশ সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। ১৯৪৬ সালের ড্রাগস রুল অনুযায়ী ফার্মাসিস্ট ও ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ মজুত, প্রদর্শন ও বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাঞ্ছারামপুরের বেশির ভাগ ফার্মেসীরই অনুমোদন নেই। অনেকের লাইসেন্স নবায়ন নেই।
এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কার্যালয়ের ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, ফার্মেসী ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই বৈধ ড্রাগ লাইসেন্স নিতে হবে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডাক্তার রঞ্জন বর্মন বলেন, ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া কোনভাবেই কেউ ফার্মেসীর ব্যবসা করতে পারবে না। যারা অবৈধভাবে ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ কেমিস্টস্ এন্ড ড্রাগিস্টস্ সমিতির বাঞ্ছারামপুর উপজেলা শাখার সভাপতি মো. মোবারক হোসেন বলেন, ফার্মেসীর ব্যবসা করতে হলে বৈধ ড্রাগ লাইসেন্স থাকতে হবে। অবৈধভাবে কেউ এ ব্যবসা করতে পারবে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনের নজর দেয়া উচিত।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সচেতনমহল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আপনার মতামত লিখুন : :