• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১১ আশ্বিন ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.
মর্ডাণ সার্জিক্যাল আল মদিনা রোকেয়া নূর বন্ধের দাবি

বাঞ্ছারামপুরে অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | স্টাফ রিপোর্টার সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৫, ০৮:১৩ পিএম বাঞ্ছারামপুরে অবৈধ ক্লিনিক হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লোকের বসবাস। গত কয়েক বছরে এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। স্বাস্থ্যসেবা নিতে এসে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগীরা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। প্রতিটি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রয়েছে নিজস্ব দালাল। সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তুলনায় বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। ডেলিভারি রোগী এলে নরমাল ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। সিজার করলে রোগী প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বেশি আয় হয়। 
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় বেসরকারি উদ্যোগে অসংখ্য হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব রয়েছে। তথাকথিত এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালের মধ্যে মাত্র কয়েকটির নামে মাত্র অনুমোদন রয়েছে। লাইসেন্সের জন্য আবেদিত মাত্র ১টি। বেশির ভাগই লাইসেন্সই নেই। এসব ক্লিনিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নামে মাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এসে রোগী দেখেন। বেশ কয়েকটি ক্লিনিক ও হাসপাতালের ডাক্তারদের সার্টিফিকেট ভুয়া এমন অভিযোগও রয়েছে। আর সেই কারণেই এসব ডাক্তারদের রোগী দেখালে প্রয়োজন ছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেন। নির্দিষ্ট হাসপাতালের ল্যাব ছাড়া অন্য কোথাও পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও ওইসব রিপোর্ট দেখতে চান না ডাক্তাররা। এ ছাড়া রয়েছে ডাক্তারদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ওপর কমিশন বাণিজ্য। বিভিন্ন হাট বাজারে গ্রাম্য ডাক্তারদের ভিজিট করার জন্য ক্লিনিকের লোকজন তাদের কাছে যান এবং তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ওপর ৩০ থেকে ৫০% কমিশন দেয়া হয়। গ্রাম্য ডাক্তাররা কমিশন পাওয়ার লোভে ওইসব ক্লিনিকে পাঠান। এছাড়াও গর্ভবতী কোন রোগীদের গ্রাম্য ডাক্তাররা ক্লিনিকে পাঠালে ওইসব রোগীর নরমাল ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। সিজার প্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নেন।
বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন ভুঁইফোর ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরেজমিনে ভুক্তভোগী রোগীদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করলে নানা তথ্য বেরিয়ে আসে। এসব ক্লিনিকের বেশ কয়েকটিতে প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন রোগী সিজার করা হয়। সিজার করতে গিয়ে অনেক সময় পরীক্ষা নিরীক্ষা না করার কারণে অনেক প্রসূতি এবং সন্তান মেরে ফেলেন। কোনটির সংবাদ স্থানীয় সাংবাদিকরা জানলে তাদের সঙ্গে আঁতাত করা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের সিজার করলে তাদের কমিশন বাণিজ্য অনেক গুণ বেশি। সন্তান সম্ভবা মহিলাদের স্বাভাবিক ডেলিভারি করতে চান না ক্লিনিকের ডাক্তাররা। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগীরা।
অভিযোগ রয়েছে বাঞ্ছারামপুরের মর্ডাণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রূপসদী মাহবুবুর রহমান মেমোরিয়াল হাসপাতাল, বাঞ্ছারামপুর ডিজিটাল সার্জিক্যাল হাসপাতাল, সোনারামপুর নিউ লাইফ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রোকেয়া নূর ডায়াগনস্টিক সেন্টার সহ আরও কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক নিম্নমানের রিএজেন্ট ব্যবহার করছে। অনেক সময় মেয়াদ উত্তীর্ণ রিএজেন্ট দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কারণে রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা রিপোর্ট সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। গড়ে উঠা বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ল্যাবে রয়েছে এসব অব্যবস্থাপনা। এসব ল্যাবের অধিকাংশেই ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান নেই। এসব ল্যাব থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর বেশিরভাগ সময় সঠিক রিপোর্ট পাওয়া যায় না। ল্যাবের টেকনিশিয়ানে যেসব লোক রয়েছে তাদের বেশির ভাগই কোন ইউনিফর্ম ও মাক্স পরে থাকে না। ব্যবহার করে না হাতের গ্লাভস।
সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এইডস পরীক্ষার জন্য কোন ফি নেয়া হয় না। অন্যদিকে বেসরকারি ক্লিনিকে ১২৫০ টাকা নেয়া হয়। সরকারিভাবে টি.সি/ডি.সি.ই.এস.আর/এইচভি একত্রে ১৫০ টাকা, বেসরকারি ক্লিনিকে ৪৩২ টাকা। ভি.ডি.আর.এল টেস্ট সরকারি ৫০ টাকা, বেসরকারি ২১৫ টাকা, এমপি সরকারি ২০ টাকা, বেসরকারি ২১৫ টাকা, ইউরিন ফর আর.আই.এফ সরকারি ২০ টাকা, বেসরকারি ১০০ টাকা, ইউরিন প্রেগন্যান্সি টেস্ট সরকারি ৫০ টাকা, বেসরকারি ২৯০ টাকা, এ.এস.ও টিটার ওআরএ টেস্ট সরকারি ১৬০ টাকা, বেসরকারি ৬১০ টাকা, ক্রস মেথসিন সরকারি ১০০ টাকা, বেসরকারি ৭০০ টাকা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি।
সরকারি হাসপাতালের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগীদের টেস্ট করার জন্য বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠায় কমিশনের কারণে। অনেক সময় হাসপাতালের বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট ডাক্তারদের দেখাতে চাইলে তারা ওইসব রিপোর্ট দেখতে চান না। সরকারিভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য যেসব রিএজেন্ট ব্যবহার করে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ট্রেড ওয়ার্ড কোম্পানি জার্মানি ও স্পেন। অপরদিকে বেসরকারি ক্লিনিকগুলো ভারত ও চীনের নিম্নমানের রিএজেন্ট ব্যবহার করে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কোন অনুমোদন নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জারি করা সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ী পুননির্ধারিত লাইসেন্স বা নবায়ন ফি ও সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ওই ফি’র ১৫ শতাংশ ভ্যাট আলাদা চালান ফরমে জমা দিতে হবে। এছাড়া মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন (নতুন প্রতিষ্ঠান) বা আয়কর প্রত্যয়নপত্র (পুরাতন প্রতিষ্ঠান), ভ্যাট রেজি. নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিস ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ক্ষতিকর ও অক্ষতিকর) চুক্তিপত্র ও চালানের স্ক্যান কপিও জমা দিতে হয়।
বিশেষ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিটার শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নাম-ঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র, সাহায্যকারীদের তালিকা, যন্ত্রপাতির তালিকা, বর্তমানে যেসব অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকা হাসপাতালের প্রধানের স্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। একই সাথে কত বেডের হবে তাও উল্লেখ করতে হবে।
বিভাগীয় বা সিটি কর্পোরেশন ১০-৫০ বেড হলে ৫০ হাজার, জেলায় হলে ৪০ হাজার, উপজেলায় হলে ২৫ হাজার। বিভাগীয় বা সিটি কর্পোরেশনে ৫১-১০০ বেড হলে ১ লাখ, জেলায় হলে ৭৫ হাজার, উপজেলায় হলে ৫০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়।
বিভাগীয় বা সিটি কর্পোরেশনে ১০১-২৪৯ বেড হলে ১ লাখ ৫০ হাজার, জেলায় হলে ১ লাখ, উপজেলায় হলে ৭৫ হাজার। বিভাগীয় বা সিটি কর্পোরেশনে ২৫০ বেড হলে ২ লাখ ৫০ হাজার, জেলায় হলে ১ লাখ ৫০ হাজার, উপজেলায় হলে ১ লাখ টাকা ফি জমা দিতে হবে। 
পরিদর্শন শেষে সব কিছু ঠিক থাকলে হাসপাতালের লাইসেন্স দেয়া হয়। অথচ বাঞ্ছারামপুর বেসরকারি কোন হাসপাতাল সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে হাসপাতাল ক্লিনিক বাণিজ্য করে যাচ্ছে। এই উপজেলায় স্বাস্থ্য সেবার নামে চলছে নিরীহ মানুষদের পকেট ফাঁকা করার রমরমা বাণিজ্য। অন্যদিকে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে।
বেশ কয়েকবার বাঞ্ছারামপুর ডিজিটাল সার্জিক্যাল ও মাহবুবুর রহমান মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডাক্তারের অবহেলায় রোগী মারা গেছে। পরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে এসব মিমাংসা করা হয়েছে। বাঞ্ছারামপুর সদর হাসপাতালের ২০ গজের মধ্যেই মর্ডাণ ডায়াগনস্টিক ও আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারি হাসপাতালের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক দেয়ার কোন বৈধ অনুমোদন নেই। অথচ বছরের পর বছর সঠিক কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে এসব ভুয়া ভুঁইফোড় ক্লিনিক হাসপাতাল বন্ধের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার তথাকথিত এসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নানাবিধ অনিয়মের বিরুদ্ধে স্থানীয় পত্রিকা বাঞ্ছারামপুর বার্তায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পর মাঝে মধ্যে পরিদর্শনে যায় কর্তৃপক্ষ। 
বছরখানেক পূর্বে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার তৎকালিন সহকারি কমিশনার (ভূমি) নজরুল ইসলাম এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়মিত স্বাস্থ্য সেবার মান যাচাই এবং ত্রুটি সংশোধনের লক্ষ্যে অভিযান চালান। তখন অবৈধ কার্যক্রম, লাইসেন্স না থাকা ও নবায়ন না করা, সেবার মান নিশ্চিত না করা, অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ৪টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। তিনি বাঞ্ছারামপুর ল্যাবএইড ডিজিটাল ডায়গনস্টিক সেন্টারকে ১ লাখ টাকা, মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ১০ হাজার টাকা এবং আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। তিনি বদলী হওয়ার পর আবারও পুরনো অবস্থায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো ফিরে আসে।
কথা হয় বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার রঞ্জন বর্মন এর সাথে। দ্রুতই ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন তিনি। বর্তমানে বাঞ্ছারামপুরে মাহবুবুর রহমান মেমোরিয়াল হাসপাতাল, বাঞ্ছারামপুর ইসলামী হাসপাতাল, মর্ডান ডাায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সার্জিক্যাল ডিজিটাল হাসপাতাল, ল্যাবএইড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ লাইফ প্রাইভেট হাসপাতাল ও রোকেয়া নূর ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে বেসরকারিভাবে ৯টি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর বাইরে কোন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নেই। থাকলে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান। 
এদিকে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সাধারণ মানুষ বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে তদন্তের জোর দাবি জানিয়েছে। সেই সাথে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা বাঞ্ছারামপুরের বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের দাবিও জানান। 

Side banner