ব্রাহ্মণবাড়িয়া ০৬ (বাঞ্ছারামপুর) আসনের সাবেক এমপি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ওই সময় উপজেলাবাসীর কাছে সত্যিকার অর্থেই একজন ভাল মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর রাতারাতি বদলে যান ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। তখনও বাঞ্ছারামপুরের সার্বিক উন্নয়নে বেশকিছু কাজ করেছিলেন। সেই সাথে নেতাকর্মীদেরও মূল্যায়ন করেছিলেন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ধরাকে সরাজ্ঞান করেন ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। একই সাথে তার আপন ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বাঞ্ছারামপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। বলতে গেলে ভাগিনা জনির কারণেই সীমাহিন অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতির পাশাপাশি প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু করেন। যার সর্বশেষ উদাহরণ উপজেলার সোনারামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের নেতা মরহুম নয়ন মিয়া।
২০২২ সালের ১৯ নভেম্বর বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরের স্টিল ব্রীজের সামনে নয়নকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সময় উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যানের পরামর্শে এবং একটি বিশেষ গ্রুপের বাঁধায় দুই বছর থানায় মামলা পর্যন্ত করতে পারেনি নিহতের পরিবার।
এখানেই শেষ নয়। নয়ন হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেলে মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামকে নানাবিধ কুপরামর্শ দিয়েছিলেন ভাগিনা জনি চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ বারবার ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, নয়ন একজন নীরিহ প্রকৃতির মানুষ। তার ছোট একটি বাচ্চা আছে এবং পরিবারটিও খুবই সাধারণ। অতএব প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। নয়তো প্রকৃতি এবং সৃষ্টিকর্তা একদিন এর বিচার করবে।
সেদিন ভাগিনা জনির কারণে কারও কথা শুনেননি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে হত্যাকাণ্ডটি ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ফলে পুরো উপজেলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করে।
ছাত্রদল নেতা নয়নের লাশ নিয়ে নানাবিধ ঘটনার জন্ম দেন জনি চেয়ারম্যান। রাজধানী ঢাকা থেকে নয়নের লাশ মেঘনা নদীর ফেরিঘাট দিয়ে বাঞ্ছারামপুর সদরে আসতে দেয়া হয়নি। এমনকি নয়নের গ্রাম শিবপুরেও জনি বাহিনী দাঙ্গা হাঙ্গামার ঘটনার ঘটান। জানাজা নামাজেও বাঁধা দেয়া হয়। বলতে গেলে মামা ক্যাপ্টেন তাজকে ব্ল্যাকমেইল করে নয়ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেন জনি চেয়ারম্যান।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নয়নের বাবা রহমত উল্লাহ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো কারাগারে যান ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। ২০২৪ সালের ২৩ আগস্ট অস্ট্রেলিয়া পালিয়ে যাবার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গ্রেফতার হন জনি চেয়ারম্যানও। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর জামিনে বের হয়ে আসলেও জেলখানায় দিন কাটাচ্ছেন তার মামা ৫ বারের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম।
বাঞ্ছারামপুরের সাধারণ মানুষ বলাবলি করছে, ভাগিনার কারণেই জেল খাটছেন ক্যাপ্টেন তাজ। এদিকে নয়ন হত্যার মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার এক মূর্তিমান আতঙ্ক জনি চেয়ারম্যান। ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে পুরো উপজেলায় একক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। নয়ন হত্যার মামলায় জামিনে বের হয়েই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এলাকায় অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি কৌশলে মামলা বাণিজ্য এবং মাদক নিয়ন্ত্রণও করে যাচ্ছেন। ফলে বাঞ্ছারামপুরের জনজীবনে এখনও সন্ত্রাসী জনি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
মামার ক্ষমতাবলে একাধিকবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হয়েছেন কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যান। তার বাবা কাজী মোখলেছুর রহমান ছিলেন উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের একজন নায়েব। মৃতে্যুর আগে মোখলেছুর রহমান নগদ কোন টাকা পয়সা দিয়ে যেতে পারেনি। অথচ চেয়ারম্যান হয়ে মামার ক্যাপ্টেন তাজের আর্শীবাদে আজ শতশত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তার অবৈধ টাকার একটি বড় অংশ একমাত্র বোন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শাম্মি আক্তারের কাছে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্ত্রী সাদিয়া নওশীন এমি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক আগ মুহুর্তে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সহকারি স্থপতি হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ওই পদেই কর্মরত রয়েছেন। স্ত্রীর নামেও রয়েছে অঢেল সম্পত্তি।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী জাদিদ আল রহমান জনি। পৈতৃকভাবে কিছু না পেলেও মামা ক্যাপ্টেন তাজের ক্ষমতাবলে নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েন। রাজধানী ঢাকার গুলশান সার্কেলের ৭-বড় কাঠালদিয়ায় ০.০৮২৫ একর জমি কিনেন, খতিয়ান নং ১৭৮০৫, দাগ নং ৩৬২৬, ৩৬২৭। তাছাড়া গুলশান সার্কেলের ৬-ডুমনীতে ০.২১০০ একর জমি কিনেছেন, খতিয়ান ৯৭৪৫, দাগ নং ১৩৯৭৫। এছাড়াও মতিঝিল সার্কেলের ৯-মান্ডায় ০.০৪১৩ একর জমির মালিকও জনি চেয়ারম্যান, খতিয়ান ১২৫৭০, দাগ নং ৬৫০৪, ৬৫০৫। এখানেই শেষ নয়। রাজধানীর বসুন্ধরায় ৫টি প্লট এবং ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। আফতাবনগরে ২২শত বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে, বনশ্রীতেও ফ্ল্যাট রয়েছে। পুলিশিং হাউজিংয়ে প্লট, জলসিড়িতে প্লট, গাজীপুরেও জমি কিনেছেন, উত্তরায় জমির বায়না করেছেন।
বাঞ্ছারামপুরে বিকাশের এজেন্ট ছিলেন রূপসদী গ্রামের শাহনেওয়াজ। পরে মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের সহযোগিতায় নিরীহ শাহনেওয়াজকে হুমকী ধামকী ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিকাশের এজেন্টশীপ দখল করে নেন। তারপর বিকাশের মাধ্যমে শুরু করে হুন্ডি বাণিজ্য। এই হুন্ডির মাধ্যমেই তার বড়বোন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শাম্মী আক্তারের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতেন তিনি। একসময় জনি চেয়ারম্যানের কাজী কমিউনিকেশন চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে গোয়েন্দাদের তালিকায় শীর্ষ হুন্ডি হিসেবে চিহ্নিত হয়। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানকে রক্ষা করেন। বিষয়টি দুদক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিকাশের দায়িত্ব নামকাওয়াস্তে তারই খালাতো ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ক্ষমতার ১৫ বছরে বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় হরিলুট চালিয়েছিলেন জনি চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কোথাও ১ শতাংশ কাজ না করেই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভুয়া ভাউচার তৈরি করে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। একই রাস্তা নামে-বেনামে সংস্কারের কথা বলে একাধিবার প্রকল্প পাস করে বরাদ্দকৃত টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও এলজিএসপি’র ৯ বছরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ একাধিক ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে। কাজের উন্নয়ন শতভাগ দেখানো হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। ২০-২১, ২১-২২, ২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর, কাবিখা, এডিপি ও নন ওয়েজ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন দেখিয়ে উত্তোলন করেছে কোটি টাকা। ৪০ দিনের কর্মসূচিতে কোন শ্রমিক না লাগিয়ে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে পুরো এক তৃতীয়াংশ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এদিকে জনি চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একাধিক মামলার আসামী দেলোয়ার হোসেন ওরফে মামলাবাজ পঁচা দেলু গ্রেফতার হওয়ায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। কিন্তু জনি চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো এবং জামিনে বের হওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে ভয় আতঙ্ক রয়েই গেছে। (চলবে...)
আপনার মতামত লিখুন : :