• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ড. ইউনূসের সাত দফা প্রস্তাব


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | স্টাফ রিপোর্টার আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০৪:১৩ পিএম রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ড. ইউনূসের সাত দফা প্রস্তাব

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার (২৫ আগস্ট) কক্সবাজারে আয়োজিত রোহিঙ্গা অংশীজন সংলাপে যোগ দিয়ে ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতি থামাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে তার দেওয়া সাত দফা প্রস্তাব হল
১। রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন।
২। দাতাদের অব্যাহত সমর্থন।
৩। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো।
৪। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ এবং তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
৫। আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ।
৬। গণহত্যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া।
৭। আন্তর্জাতিক আদালতে জবাবদিহিতা ত্বরান্বিত করা।
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে রবিবার থেকে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সংলাপ ‘স্টেকহোল্ডার্স’ ডায়ালগ: টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’। সোমবার স্থানীয় হোটেল বে ওয়াচে আয়োজিত এই সংলাপের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা।
উদ্বোধনী বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মভূমির সাথে তাদের নাড়ির সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না। এখন আর কেবল কথায় সীমাবদ্ধ থাকা যাবে না। কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়।
দাতা দেশ ও সংস্থা এবং মানবিক অংশীদারদের অব্যাহত সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছে আবেদন জানাই, তারা যাতে তাদের অঙ্গীকার বাড়ান এবং ২০২৫-২৬ সালের যৌথ পরিকল্পনার তহবিল ঘাটতি পূরণ করেন।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও জীবিকা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অপরিহার্য মন্তব্য করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আসিয়ান ও প্রতিবেশী দেশগুলোকে আরও সক্রিয়ভাবে রাখাইন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে মানবপাচার, মাদক চোরাচালান ও ক্ষুদ্র অস্ত্রের অবৈধ ব্যবসার মত আন্তঃসীমান্ত অপরাধ দমনে উদ্যোগী হতে হবে।
রোহিঙ্গা সমস্যা এবং এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক এজেন্ডায় রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এই সংহতির চেতনায়, গত রমজান মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং আমি কক্সবাজারে এক লাখ রোহিঙ্গার সাথে একত্রে ইফতার করেছি। আমরা রোহিঙ্গাদের আকুল আগ্রহের কথা শুনেছি—যত দ্রুত সম্ভব তারা তাদের ঘরে ফিরে যেতে চায়।
গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিন দফা প্রস্তাব উপস্থাপনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমার আহ্বানকে স্বীকৃতি জানিয়ে এ বছরের সাধারণ পরিষদে উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমি আশা করি, কক্সবাজারের এই সংলাপ নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে যথেষ্ট অবদান রাখবে এবং রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানের রোডম্যাপ তৈরিতে সহায়ক হবে।
অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে ২০১৭ সালের অগাস্টে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই বর্বরোচিত আক্রমণ ও নিপীড়ন এখনও চলমান।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি বিশ্ব সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ সীমিত সম্পদ নিয়েও মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ, যা কক্সবাজারকে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত করেছে। প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিচ্ছে, অথচ মিয়ানমারে এখন পাঁচ লাখের কম রোহিঙ্গা রয়েছে। এটা প্রমাণ করে, চলমান নিপীড়নের কারণে তারা মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দীর্ঘ আট বছর কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা ‘অসীম ত্যাগ’ স্বীকার করেছেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সতর্ক করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ যা করেছে, এর বেশি ব্যয় করা বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়। তাই সংকট নিরসনে বৈশ্বিক সহযোগিতা এখন অত্যন্ত জরুরি।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত মিয়ানমার থেকে। সমাধানও সেখানেই নিহিত। সকল পক্ষকে দ্রুততম সময়ে কঠিন দৃঢ়তার সাথে এই সংকটের অবসান ঘটাতে হবে।
রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ তাদের পাশে রয়েছে এবং তাদের মাতৃভূমিতে দ্রুত ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য কাজ চালিয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, চলুন আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে তাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে অবদান রাখার অঙ্গীকার করি, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করি।
রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস স্মরণে অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
অন্যদের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাই কমিশনার রাউফ মাজু অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিকদলের নেতা, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা সংলাপে অংশ নিচ্ছেন।

Side banner