ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ভৌগোলিক অবস্থান ও কৃষি অর্থনীতিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান মাপকাঠি নারীশিক্ষা এর অবকাঠামোগত দিক দিয়ে এই অঞ্চলটি আজও অনেকটা পিছিয়ে। বর্তমানে এই উপজেলায় উচ্চশিক্ষার জন্য নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো ডেডিকেটেড মহিলা কলেজ। ফলে উচ্চশিক্ষা লাভের আকাঙ্ক্ষী অসংখ্য ছাত্রীকে প্রতিদিন দূর-দূরান্তে পাড়ি দিতে হয়, যা তাদের শিক্ষা জীবনকে অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। শিক্ষা অর্জনের এই মৌলিক অধিকারকে সুরক্ষিত ও সহজলভ্য করার জন্য বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা আজ সময়ের দাবি, যা কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং নারী জাগরণ ও স্থানীয় উন্নয়নের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।
১. বর্তমান প্রেক্ষাপট ও উচ্চশিক্ষার প্রতিবন্ধকতা
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের পড়াশোনার হার বেড়েছে। উপজেলা সদর এবং তার আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় ও সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিক (ঐঝঈ) পাস করছে। কিন্তু তাদের জন্য এর পরবর্তী ধাপের শিক্ষা অর্জন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রধান সমস্যাগুলো হলো:
ক. দূরত্ব ও যাতায়াত সমস্যা: বাঞ্ছারামপুর থেকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা বা জেলা সদরে (যেমন ঢাকা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা কুমিল্লা) গিয়ে ডিগ্রি বা অনার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। বর্ষাকালে বা যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল হলে এই কষ্ট বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।
খ. আর্থিক চাপ: দূরবর্তী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা মানেই যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি, অথবা শহরে থাকার খরচ বহন করা। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এই অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সহ্য করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ফলস্বরূপ, অনেক মেধাবী ছাত্রী উচ্চশিক্ষা অর্জনের আগেই ঝরে পড়তে বাধ্য হয়।
গ. নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক বাধা: অভিভাবকদের প্রধান উদ্বেগের কারণ হলো মেয়েদের নিরাপত্তা। দূরের শহরে এককভাবে বা হোস্টেলে থাকা অনেক রক্ষণশীল পরিবার পছন্দ করেন না। আবার, দীর্ঘ যাতায়াতের পথেও নিরাপত্তা ও সময়ক্ষেপণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই সামাজিক ও পারিবারিক বাধার কারণেই বহু পরিবার মেয়েদের মাধ্যমিকের পর বিয়ে দিয়ে দেন, যা বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। একটি স্থানীয় মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে এই সকল সমস্যা রাতারাতি দূর হয়ে যাবে। মেয়েরা ঘরের কাছেই নিরাপদে এবং স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারবে।
২. নারীশিক্ষার প্রসারে মহিলা কলেজের গুরুত্ব
নারীর ক্ষমতায়ন এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নারীশিক্ষা অপরিহার্য। বাঞ্ছারামপুরে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলো আসবে:
ক. ঝরে পড়া হ্রাস ও ভর্তি বৃদ্ধি; যেসব ছাত্রী আর্থিক অসচ্ছলতা বা দূরত্বের কারণে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও ঝরে পড়ে, তারা কলেজে ভর্তি হতে উৎসাহিত হবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হলে উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের হার তাৎক্ষণিকভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। এটি নিশ্চিত করবে যে নারীরা কেবল অক্ষর জ্ঞান অর্জন করছে না, বরং জ্ঞানভিত্তিক সমাজে অবদান রাখার জন্য উপযুক্ত ডিগ্রিও অর্জন করছে।
খ. গুণগত শিক্ষার মানোন্নয়ন; মহিলা কলেজটি প্রতিষ্ঠার সময় যদি বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য—তিন বিভাগেই ডিগ্রি বা অনার্স কোর্স চালু করা যায়, তবে ছাত্রীরা তাদের পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারবে। সুষ্ঠু অবকাঠামো, আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং মানসম্পন্ন শিক্ষকের সংস্থান করা গেলে এই কলেজটি স্থানীয় শিক্ষার মানকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
গ. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ; যে সমাজে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম থাকে, সেখানে বাল্যবিবাহের প্রবণতা হ্রাস পায়। যখন অভিভাবক নিশ্চিত থাকেন যে তাদের মেয়েরা ঘরে বসেই একটি সম্মানজনক ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে, তখন তারা দ্রুত বিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েদের শিক্ষাজীবনকে অগ্রাধিকার দেন। একটি মহিলা কলেজ কেবল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামাজিক দুর্গ হিসেবে কাজ করবে।
৩. বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
একটি মহিলা কলেজের প্রভাব শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি পুরো উপজেলার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।
ক. স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি; কলেজটি চালু হলে প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারীসহ বিভিন্ন পদে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এই কর্মসংস্থান স্থানীয় শিক্ষিত যুবকদের জন্য বিশেষত নারীদের জন্য অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে।
খ. সচেতনতা ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি; উচ্চশিক্ষিত নারীরা তাদের অধিকার, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সমাজের প্রতি তাদের ভূমিকা সম্পর্কে অধিক সচেতন হন। তারা পরিবার এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হন। বাঞ্ছারামপুরের নারীরা যদি শিক্ষিত হন, তবে এটি শুধু তাদের পরিবারকেই নয়, পুরো সমাজকে আলোকিত করবে। নারীর ক্ষমতায়ন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএ) অর্জনের জন্য অপরিহার্য।
গ. অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি; নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলে পারিবারিক আয় বাড়ে। উচ্চশিক্ষিত নারীরা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে অথবা নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করে স্থানীয় অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে। শিক্ষাই দারিদ্র্য বিমোচনের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।
৪. সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বাস্তবায়ন কৌশল
বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষানুরাগী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠার পথে করণীয়:
ক. জমি অধিগ্রহণ ও অর্থ বরাদ্দ: একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে জমি অধিগ্রহণ করা এবং অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। সমাজ হিতৈষী ব্যাক্তিগণের দানের মাধ্যমে এই জমি সংগ্রহ করা যেতে পারে।
খ. বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন: কলেজের পাঠ্যক্রম, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি এবং শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা। বাঞ্ছারামপুরের শিক্ষানুরাগী সুধীজন এ ব্যাপারে আগ্রহী আছে বলে জানি।
গ. জনগণের অংশগ্রহণ: কলেজটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় সুধীজন, বিত্তবান ব্যক্তি, ব্যবসায়ী এবং প্রবাসীদের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন আহ্বান করা।
৫. প্রতিবেশী মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার গল্প জানুন
ক. বাঞ্ছারামপুরের উত্তর-পশ্চিম দিকে পার্শ্ববর্তী নরসিংদী জেলা সদরে ব্রাহ্মন্দীর জমিদার বাবু জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের সহায়তায় ১৯৪৯ সালে নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা ১৯৮০ সালে সরকারীকরণ হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেঘনা পাড়ি দিয়ে বাঞ্ছারামপুরের অনেকেই এই কলেজে লেখাপড়া করে।
খ. ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৬৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রশাসক মরহুম এম এম নূর-উন-নবী চৌধুরীর উৎসাহে দানবীর ও সমাজসেবী স্বর্গীয় বাবু নিত্যানন্দ পাল (নিতাই পাল খ্যাত), বিশিষ্ট সমাজকর্মী মরহুম গাজিউর রহমান সহ শহরের গণ্যমান্য সুধী বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায় ১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজ স্থাপিত হয় যা ১৯৮৪ সালে সরকারীকরণ হয়।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যাতায়াত ব্যবস্থা দূরহ বিদায় ইচ্ছা থাকলেও খুব কম সংখ্যক মেয়েরাই সেখানে পড়তে যায়।
গ. বাঞ্ছারামপুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা মুরাদনগর হয়ে দেবীদ্বার উপজেলায় বিশিষ্ট সমাজসেবক, সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী ১৯৯২ সালে ‘দেবীদ্বার আলহাজ্ব জোবেদা খাতুন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মুরাদনগরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় মুরাদনগর এর চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। সাধারণত বাঞ্ছারামপুরের মেয়েরা সেখানে দূরত্বের কারণে পড়তে যায়না।
ঘ. বাঞ্ছারামপুরের পশ্চিম দিকে পার্শ্ববর্তী আড়াইহাজার উপজেলায় আলহাজ্ব মোঃ রোকনউদ্দিন মোল্লা ১৯৯৭ সালে ‘রোকন উদ্দিন মোল্লা গার্লস ডিগ্রি কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাঞ্ছারামপুরের পশ্চিমাঞ্চলের কিছু মেয়েরা উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে এই কলেজে লেখাপড়া করে।
ঙ. বাঞ্ছারামপুরের উত্তর-পূর্ব দিকে পার্শ্ববর্তী নবীনগর উপজেলায় বিশিষ্ট সমাজসেবক, সাবেক সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অ্যাডভোকেট আবদুল লতিফ ১৯৯৮ সালে ‘নবীনগর মহিলা ডিগ্রি কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।বাঞ্ছারামপুরের পূর্বাঞ্চলের কিছু মেয়েরা এই কলেজে লেখাপড়া করে।
চ. বাঞ্ছারামপুরের দক্ষিণ দিকে পার্শ্ববর্তী হোমনা উপজেলায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজ সেবক অধ্যাপক আব্দুল মজিদ ১৯৯৯ সালে ‘হোমনা রেহানা মজিদ মহিলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাঞ্ছারামপুরের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু মেয়েরা এই কলেজে লেখাপড়া করে।
আহ্বান; বাঞ্ছারামপুর মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা এখন কেবল একটি আকাঙ্ক্ষা নয়, এটি একটি জরুরি প্রয়োজন। নারী শিক্ষার প্রসারে এই বিনিয়োগ ভবিষ্যতের উন্নত, সচেতন এবং প্রগতিশীল বাঞ্ছারামপুর গড়ার মূল ভিত্তি স্থাপন করবে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, আর নারীশিক্ষা সেই মেরুদণ্ডের মূল স্তম্ভ। আমরা আশা করি, বাঞ্ছারামপুরের জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ এবং সরকার প্রধান অতি দ্রুত এই প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে উদ্যোগী হবেন, যাতে আগামী প্রজন্ম ঘরের কাছেই উচ্চশিক্ষার আলোয় নিজেদের জীবনকে আলোকিত করতে পারে।
লেখক; অ্যাডভোকেট মীর হালিম
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল (এএজি), বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন : :