“শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি, তুমিই স্বপ্নের নায়ক! তুমিই নেতা! তুমিই পিতা! ধন্য তোমার জীবন”--- অ্যাড. মীর হালিম
হ্যালো, আশরাফ ভাই! “শুনেছি সেদিন তুমি, এঁকেছিলে জন্মভূমি”! তুমিই স্বপ্নের নায়ক! তুমিই নেতা, তুমিই পিতা! ধন্য তোমার জীবন।
আজ ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ বাঞ্ছারামপুরের বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফ ভাইয়ের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই ভক্তের নিবেদন। এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নের মাছিমনগর গ্রামে উনার কবরে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এতে বাঞ্ছারামপুরের রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাক্তিবর্গ, পরিবারের সদস্য ও অনুসারীরা যোগ দিচ্ছেন।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭ ইং এ জন্মে ১৯ নভেম্বর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে পরপার, ৫৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন যেন সাধারণ, অনাড়ম্বর ও কর্মময় জীবনের প্রতিচ্ছবি! “ওয়ালী আশরাফের মত এমন গুণী নেতা আর আসবে না” সাধারণ মানুষের এই আফসোসই উনার সফল জীবনের ইঙ্গিত বহন করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রামে জন্ম। পিতা: আলহাজ্ব মোঃ আতিক উল্লাহ, রেলওয়ে বিভাগে চাকরি ও তৎকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতি পছন্দ করতেন এবং মাতা আলহাজ্ব নূর জাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী ।
ভাই-বোনের মধ্যে ২য় কিশোর আশরাফ লেখাপড়ার জন্য বাঞ্ছারামপুর ছেড়ে নানাবাড়ি ও মামার কর্মস্থল দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরে লে আসেন। তার মেন্টর, মামা ডা. সামসুল ইসলাম তাকে গৌরীপুর সুবল আফতাব হাই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন এবং সেখান থেকে তিনি ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ডাক্তার শামসুল ইসলাম গৌরীপুর থেকে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন করেছিলেন এবং সেই রাজনীতির ছোঁয়া আমাদের আশরাফের গায়েও লেগেছে। কৈশোরে তিনি মামার সমাজ, দেশ ও রাজনীতি বিষয়ক ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
তারপর চলে যান আরেক মামার কাছে যিনি থাকতেন বরিশাল। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। সেখান থেকে ১৯৬১ সালে বি.এ (অনার্স) ও ১৯৬২ সালে এম.এ (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন রাজনীতিতে হাতেখড়ি। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। একই সালে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন। এরপর সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর বিশ্ব সেরা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)’ তে কাজের সুযোগ পেয়ে যান আমাদের অজপাড়া গাঁ ডোমরাকান্দির আশরাফ! চলে যান লন্ডনে। বিবিসিতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তিনি চিন্তা করলেন লন্ডনে একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করার। ১৯৬৯ সালে উনার সম্পাদনায় শুরু হলো “সাপ্তাহিক জনমত” প্রকাশ। ইতিহাস বলে উনার প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকাই হল বিদেশের মাটিতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত প্রথম বাংলা পত্রিকা। সময়ের তুলনায় চিন্তায় অগ্রসর ছিলেন আমাদের প্রিয় আশরাফ!
এমন সময় বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। শুরু হয়ে গেল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি ‘সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকা’র মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে, সংবাদ প্রচার ও লিখতে থাকলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্যারিস সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করেছেন। তাঁর এই অনবদ্য ভূমিকার জন্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়। আজ ৩০ বছর পরও বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা বিস্মৃত প্রায় ওয়ালী আশরাফকে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কণ্ঠস্বরের স্থপতি হিসেবে সম্মান জানায়!
আশরাফ ভাই ছিলেন দিল দরিয়া লোক, উনি লন্ডনে থাকাকালে অনেক বাঙালি ওনার বাসায় থেকেছেন। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার পর লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকেও সাপ্তাহিক জনমত প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে বাকশাল কায়েমের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ৪ টি পত্রিকা বাদে সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে বেশি মনোযোগ দেন। ১৯৭৬ সালে ডেমোক্রেটিক লীগে যোগ দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা অলি আহাদের সভাপতিত্বে এটিএম ওয়ালী আশরাফ ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। বাকশাল কায়েমের কারণে তাদের রাজনীতি করার সুযোগ কমে যায়। ডেমোক্রেটিক লীগ তার রাজনৈতিক আবেদন হারায়, নেতারা বিচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন দলে যোগদান করে। তিনি ধীরে ধীরে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বীর উত্তমের জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে বিএনপি’তে যোগ দেন।
কালক্রমে হয়ে উঠেছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় জনদরদী রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবক। মরহুম আশরাফ ছিলেন প্রকৃত অর্থে মা মাটি ও মানুষের নেতা। ব্রাহ্মণাড়িয়া-৬ বাঞ্ছারামপুর থেকে পরপর ২ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯৮৮তে স্বতন্ত্র থেকে মোমবাতি প্রতীকে ও দ্বিতীয়বার ১৯৯১তে বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথম ১৯৮৬ সালে মোমবাতি মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টি মনোনীত মোঃ সহিদুর রহমানের লাঙ্গল প্রতীকের কাছে হেরে জান। ২৮,০০০ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হয় দরিয়াদৌলত ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের মোঃ সহিদুর রহমান। এটিএম ওয়ালী আশরাফ পেয়েছিলেন ২০,০০০ ভোট। কথিত আছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক লে. জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সহিদ ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয়বার ১৯৮৮ সালে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোমবাতি মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির মোঃ শহীদুর রহমান লাঙ্গল প্রতীককে পরাজিত করে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন।
তারপর ১৯৯১ ইং সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি’ থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ৩৫,১৭২ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বার এমপি নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে ক্যাপ্টেন (অব:) এবি তাজুল ইসলাম, প্রাপ্ত ভোট ৩০,৬১৩। আশরাফ ভাই তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
পারিবারিকভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে ইসলামী শরীয়া মোতাবেক বিয়ে করেন রেবেকা সুলতানাকে, পরবর্তীতে তিনি রেবেকা ওয়ালী হিসেবে পরিচিত হন। ভাবির ডাক নাম ছিল রোজি। ঢাকার বাসিন্দা পুলিশ কর্মকর্তা বাবা আর গৃহিনী মায়ের সুসন্তান ছিল রোজি ভাবি। ভাবী অত্যন্ত সদালাপী ও অতিথি পরায়ণ ছিলেন। স্বাচ্ছন্দ ও সুখী দাম্পত্য জীবনের উদাহরণ এই আশরাফ-রোজি দম্পতি।
১৯৯০ সালে মক্কা-মদিনায় তিনি সস্ত্রীক পবিত্র হজব্রত পালন করেন। এই দম্পতির ৩ সন্তান রয়েছে যথাক্রমে রাইকা ওয়ালী খান (ইউএনডিপিতে কর্মরত, ঢাকায় বসবাস), মৌলি সামিরা ওয়ালী রহমান (লন্ডনে বসবাস) ও রুদ্র তৌহিদ ওয়ালী (ব্যাবসা ও ঢাকায় বসবাস)। ইদানিং রাইকা আপা বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন,কয়েকটি অনুষ্ঠানে উনার সাথে আমার সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছে।
বাঞ্ছারামপুরের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নে উনার অবদান রয়েছে। কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনে উৎসাহ প্রদান করেন। বাঞ্ছারামপুর সরকারী কলেজটি অর্থের অভাবে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম থেকে রক্ষা করতে ১৯৭৮ সালে তিনি নিজে নগদ ২০,০০০/- টাকা (আজকের অর্থমূল্যে হয়ত ২ কোটি টাকার মত হতে পারে) অনুদান প্রদান করেন যা কলেজের অনার বোর্ডে, সর্বাগ্রে, আজও স্বর্ণাক্ষরে জ্বল জ্বল করছে। নিজে সাংবাদিক হওয়ায় সংবাদ পত্র ও সাংবাদিকদের প্রতি যত্নশীল ছিলেন। সাংবাদিকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে মনে করে মফস্বল শহর বাঞ্ছারামপুর প্রেসক্লাব স্থাপনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন যা আজকে একটি বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে সড়ক পথ নির্মাণ ও বাস্তবায়নে তিনি বাঞ্ছারামপুরের ম্যাপে প্লাস (+) চিহ্ন এঁকে বলেছিলেন আমাদের প্রিয় বাঞ্ছারামপুর ৪ দিক দিয়ে রাজধানী ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর, শিল্প শহর নরসিংদী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত হবে। ১. উত্তরে, বাঞ্ছারামপুর সদর-দশদোনা-সোনারামপুর-মেঘনার তীরে মরিচা ঘাট থেকে নরসিংদী ও ঢাকা সিলেট মহাসড়ক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে সংযোগ। ২. দক্ষিণে, বাঞ্ছারামপুর সদর-উজানচর-রাধানগর--কালিকাপুর থেকে হোমনা হয়ে গৌরিপুর দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে সংযোগ। ৩. পূর্বে, বাঞ্ছারামপুর সদর-আসাদনগর-রূপসদী-ফরদাবাদ থেকে রামচন্দ্রপুর দিয়ে কুমিল্লা হয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে সংযোগ। অপর একটি বাইপাস আসাদনগর থেকে ফতেপুর হয়ে ছয়ফুল্লাকান্দি শাহ রাহাত আলী দরগা হয়ে দড়িকান্দি মাঝিআরা বাজার দিয়ে নবীনগর উপজেলা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে সংযোগ। ৪. পশ্চিমে, বাঞ্ছারামপুর সদর-আইয়ুবপুর-কড়ইকান্দি-ফেরিযোগে বিশনন্দি হয়ে আড়াইহাজার-গাউসিয়া দিয়ে ঢাকা সিলেট মহাসড়কে সংযোগ। আজকের কড়ইকান্দি-মেঘনা- বিশনন্দি ফেরি যোগাযোগ ও এখানে ৫ম মেঘনা সেতু নির্মাণের স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন আমাদের প্রিয় আশরাফ ভাই।
কালের আবর্তে ৩০ বছর পর আজ ঢাকা-আগরতলা মহাসড়ক হচ্ছে আমাদের আশরাফ ভাইয়ের আঁকা প্লাস (+) চিহ্নের উপর দিয়ে ঢাকা-গাউসিয়া-আড়াইহাজার-বিশনন্দি কড়ইকান্দি ফেরিঘাট-আইয়ুবপুর-বাঞ্ছারামপুর সদর-আসাদনগর-ফতেপুর-ছয়ফুল্লাকান্দি শাহ রাহাত আলী দরগা-দড়িকান্দি মাঝিআরা বাজার- নবীনগর উপজেলা দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদর সংযুক্ত হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার সাথে সংযোগ। আরো উল্লেখ্য, একনেকে কড়ইকান্দি-বিশনন্দি ফেরিঘাটে ৫ম মেঘনা ব্রীজের অনুমোদন হয়েছে যা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
জননেতা আশরাফ ভাই কৃষক শ্রমিক জনতার সাথে সহজে মিশতে পারতেন, হাত মেলাতেন, আলিঙ্গন করতেন, জমির আইলে বসে খাবার খেয়েছেন, হুক্কা টেনেছেন। প্রখর স্মরণ শক্তি ছিল, কাউকে একবার দেখার বহুদিন পর দেখলেও নাম ধরে ডাকতে পারতেন। নির্লোভ, সৎ, অনাড়ম্বর ও দূর্নীতিমুক্ত জীবনের এক দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণের নাম এটিএম ওয়ালী আশরাফ, আমাদের প্রিয় নেতা।
বিদেশে ও ঢাকায় স্যুট প্যান্ট পরলেও বাঞ্ছারামপুরে গেলে বেশিরভাগ সময় সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরতেন। জুতা, হাত ঘড়ি আর ছাতা ছিল সঙ্গী। পাইপ যোগে সিগারেট টানার ছবিটা আজো দৃষ্টি নন্দন! চেহারার সাথে পাঞ্জাবি স্টাইলের গোঁফটা যেন যেন অসাধারণ নবাবী স্টাইল! ফ্যাশন ও স্টাইলের অপূর্ব সমন্বয়ে সাধারণ পরিবেশ থেকে রাজকীয় আয়োজনে নিজেকে খুব সহজেই মানিয়ে নেওয়া বা নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন আমাদের প্রিয় আশরাফ ভাই।
মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ১৯৯৪ ইং সালে এমপি থাকা অবস্থায় বাঞ্ছারামপুরের কৃতি সন্তান এটিএম ওয়ালী আশরাফের অকাল মৃত্যু হয়। ফুসফুসের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। (২০২৩ সালের নভেম্বরে আমি ওই হাসপাতাল ভিজিট করেছি।) পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা আশার আলো না পেয়ে রোজি ভাবিকে ঢাকায় ফিরিয়ে নিতে পরামর্শ দেন। উনার পলিটিক্যাল সেক্রেটারি এবং এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদের সভাপতি জনাব আব্দুস সাত্তার সরকারের ভাষ্য মতে উনাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনাতে বন্ধুরা সহযোগিতা করেছিল।
আসার দিন বিমান ১২ ঘন্টা লেট হয়। সন্ধ্যা ৭ টায় পৌঁছার কথা কিন্তু বিমান পৌঁছেছিল পরের দিন ভোর ৭টায়। উনাকে বাসায় আনা হলো। দুপুরের পর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে উনাকে দ্রুত সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হাসপাতালের খুব কাছাকাছি গিয়ে উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দিনটি ছিল শনিবার, ১৯ নভেম্বর ১৯৯৪ ইংরেজি।
ছয়ফুল্লাকান্দি ইউনিয়নে মাছিমনগর গ্রামে শাহ রাহাত আলী দরগা মসজিদের পশ্চিম পাশে উনাকে কবরস্থ করা হয়। ১৯৯৮ সালে স্ত্রী মরহুমা রেবেকা ওয়ালী (রোজি) ইন্তেকাল করলে উনাকেও আশরাফ ভাইয়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। পাশাপাশি আছে দুজনের কবর। আল্লাহ উনাদেরকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আশরাফ ভাইকে উনার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী মাজার সংলগ্ন মসজিদের পশ্চিম পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। কবি নজরুলের ইচ্ছার মতই আশরাফ ভাই আনমনে গেয়েছিলেন “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
দীর্ঘ স্বৈরাচারী আমলে উনার কবরটি পদ্ধতিগত অবহেলার শিকারে বেহাল দশা হয়েছিল। নাম ফলক মুছে গিয়েছিল, সৌন্দর্যের ফুল গাছগুলো মৃতপ্রায়, বাতির অভাবে কবরস্থান ছিল অন্ধকার, নিয়মিত আবর্জনা পরিষ্কার করা হত না। এই কবরের পাশে দিয়ে হেঁটে গেলে কেউ বলতে পারত না যে এটি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাঞ্ছারামপুরের ২ বারের সাবেক এমপি ও উনার স্ত্রীর কবর।
২৪এর ছাত্র জনতার জুলাই বিপ্লবের পর স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে উনাদের কবরের সাধারণ কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল পরবর্তীতে ওনার সন্তানদের ইচ্ছায় এ বছর কিছু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। কবরটিকে উন্নত রূপে সংরক্ষণ ও দৃষ্টিনন্দন করার জন্য পরিকল্পনা আছে বলে পরিবার থেকে জানা যায়।
বাঞ্ছারামপুরে উনার স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে মহিলা কলেজ, মাদ্রাসা, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ইয়াতিমখানা, অটিজম বা স্পেশাল স্কুল, প্রেসক্লাব ভবন, পাবলিক লাইব্রেরি, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইংলিশ ভার্সন স্কুল, সাধারণ স্কুল/কলেজ ও বিভিন্ন পাবলিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে উনার নামে নামকরণ করার স্বপ্ন দেখা কী খুব অবাস্তব হবে? সমাজে ভবিষ্যতে গুণীজন আগমনের জন্য পূর্বপুরুষদের কদর করার প্রবাদ কি শুধু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে? ২ বারের সাবেক এমপির নামে বাঞ্ছারামপুরে:অন্তত ১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম কী হতে পারত না! যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না’ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আফসোসের বাণীটি কী বাঞ্ছারামপুরেরই প্রতিফলিত হতে হল? দূরভাগ্য আমাদের!
প্রতিবারই নির্বাচনী প্রচারণা তিনি মাজার শরীফ থেকেই শুরু করতেন। শাহ রাহাত আলী মাজার শরীফকে ঘিরে আশরাফ ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল, মাজারটিকে ঘিরে একটি আদর্শ কমপ্লেক্স স্থাপন করা, মাজার জিয়ারতে আসা ভক্তদের জন্য মুসাফিরখানা/লঙ্গরখানা থাকা, এতিমখানা ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা, মাজার শরীফ ও মসজিদের সংস্কার করা ইত্যাদি। উনার কৃতিময় জীবনকর্মকে স্মরণ ও বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৯৪ সালে মরহুম এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়েছিল। উনার ব্যক্তিগত সহকারী, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সাবেক সদস্য ফরদাবাদের আব্দুস সাত্তার সরকারের প্রচেষ্টায় এই সংগঠনটি মরে মরে কোন রকম বেঁচে আছে! তিনি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তেমন কোন ফান্ড নাই। আশরাফ ভাইয়ের মৃত্যু পরবর্তী বিএনপি নেতৃবৃন্দের উদাসীনতার জন্য উনার আফসোস হয়। উনার প্রত্যাশা রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তরুণ প্রজন্ম এই সংগঠনকে গতিশীল করবে, উনার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবে, উনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, রাজনৈতিক পূর্বপুরুষদের প্রতি, পথ প্রদর্শকদের প্রতি, গুরুজনদের প্রতি, আমরা যারা আদর্শিক উত্তরাধিকার, চেতনার উত্তরাধিকার, রক্ত মাংসের উত্তরাধিকার, সুবিধার উত্তরাধিকার, আমাদের দায় স্বীকার করার সংস্কৃতি চর্চা করা আবশ্যক। পদ-পদবী অবস্থান, বর্ষা বা সুদিন নির্বিশেষে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা উচিত নতুবা আমাদের কবরের হয়ত একই দশা হতে পারে!
ধৈর্য সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। এটিএম ওয়ালী আশরাফ অমর হোক, জাতীয়তাবাদ-জিন্দাবাদ, স্মৃতি সংসদ-জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।
নোট: পরিবারের সাথে আলাপ, অনুসারীদের বক্তব্য, সরকারি দপ্তর ও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী লিখেছি। তথ্যের গরমিল বা পরামর্শ থাকলে যোগাযোগ করার অনুরোধ করছি।
নিবেদনে:
অ্যাডভোকেট মীর হালিম
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ
(সদস্য, এটিএম ওয়ালী আশরাফ স্মৃতি সংসদ, বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম)
আপনার মতামত লিখুন : :