বিশ্বের প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো বিষয়ে শিক্ষিত। শিক্ষা প্রধানত দুই প্রকার- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যে শিক্ষা লাভ করে তাকে বলা হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অপরদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হয়ে যে শিক্ষা অর্জন করা হয় তাকে বলা হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয়ক্ষেত্রে যাঁরা শিক্ষা লাভ করেন তাদেরকে বলা হয় শিক্ষিত। এই শিক্ষিতদের চার ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন- স্বশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত।
(১) স্বশিক্ষিত- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে মা-বাবার কাছে কিংবা গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে যারা শিক্ষা লাভ করেন তাদেরকে বলা হয় স্বশিক্ষিত। জীবনে কোনোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে দেশবিখ্যাত হিসেবে স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম- নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শিশুসাহিত্যিক ও দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সাবেক ফিচার এডিটর এখলাসউদ্দিন আহমদ ও সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
(২) অল্পশিক্ষিত- যারা ক্লাস ওয়ান থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাদেরকে বলা হয় অল্পশিক্ষিত। বর্তমানে এসএসসি পাস করা ব্যক্তিদেরও অল্পশিক্ষিত বললে অত্যুক্তি হবে না। অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে দেশপ্রেম ও বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ বেশি। তুলনামূলক ভাবে উচ্চশিক্ষিতদের চেয়ে অল্পশিক্ষিত মানুষের অহংকার কম।
আমাদের দেশটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়ের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রবাসী বাংলাদেশি বলতে আমরা বুঝি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশই অল্পশিক্ষিত কিংবা স্বশিক্ষিত। তারা দেশে মা-বাবা,ভাইবোন ও স্ত্রী-সন্তানাদি রেখে কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের জন্য টাকা পাঠান,কিন্তু জন্মভূমিতে এসে তারা হয়ে পড়েন অসম্মানের পাত্র ও সুবিধা বঞ্চিত।
অপরদিকে উচ্চশিক্ষিত বেকার ভাইবোনদের ঘরেবাইরে সামাজিক মূল্যায়ন অনেক বেশি। রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ উচ্চ শিক্ষিতদের দেখলে সালাম দেয়। কারণ,তারা উচ্চ শিক্ষিত। এই বৈষম্যনীতি স্বচোক্ষে দেখে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে। কষ্টে তারা মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এ ধরনের গোপন কষ্ট তারা বছরের পর বছর বহন করে চলেছেন। এদিকে বেকার উচ্চ শিক্ষিতদের দ্বারা পরিবারসহ রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। সেই সঙ্গে তারা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কারণ,তাদের ছাত্রজীবনের উচ্চাঙ্খার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
বিদেশে কর্ম করতে গিয়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেখেছেন সেখানে শুধু কাজের মূল্যায়ন বেশি। এদেশ থেকে শ্রমিক হিসেবে ভিসায় চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষিত আর অল্পশিক্ষিতদের একই কাজ করতে হয়।
সেখানে কে উচ্চশিক্ষিত, কে অল্পশিক্ষিত সেদিকে বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারা আলাদা দৃষ্টিতে দেখেন না। তাঁরা শুধু কাজের পারদর্শিতা বা অভিজ্ঞতাকেই বেশি গুরুত্ব দেন।
আমাদের দেশের অনেক শীর্ষ ব্যবসায়ীর উচ্চতর ডিগ্রি নেই। কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষিতরা চাকরি করেছেন বা করছেন। শুধু তাই নয়,একই বিদ্যাপীঠে অধ্যয়নকালে পেছনের বেঞ্চের কম মেধাসম্পন্ন সহপাঠী কর্মজীবনে তার পরিশ্রম ও ইচ্ছাশক্তির বলে শিল্পপতি বা শীর্ষ ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। তাদের অধীনে সেই ছাত্রজীবনে ক্লাসে যাদের রোল নং এক বা দুই ছিল তারাও চাকরি করেছেন বা করছেন। এ নজির এদেশে সংখ্যা কম হলেও বাস্তবে প্রমাণিত।
(৩) উচ্চশিক্ষিত: স্নাতক ও স্নাতকোত্তরসহ উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করে যাঁরা সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে কর্মরত আছেন তাদেরকে বলা হয় উচ্চশিক্ষিত। উচ্চশিক্ষিতদের অহংবোধ অত্যধিক। বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়-স্বজনসহ সাধারণ মানুষ তাদের আচার আচরণে মনোক্ষুণ্ণ। আমাদের দেশে একটি প্রচলিত কথা আছে যে,উচ্চশিক্ষিতরাই বেশি দুর্নীতির সাথে জড়িত। কথাটি নির্মম হলেও সত্যি।
ও (৪) সুশিক্ষিত: প্রকৃত-অর্থেই সুশিক্ষিতরা বেশি বিবেকবান। তারা মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সুশিক্ষিতদের দ্বারা দেশ ও জাতি বেশি লাভবান। তাদের মধ্যে রয়েছে মূল্যবোধের চর্চা। সেই সঙ্গে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত বলে তারা সমাজের সফল মানুষ হিসেবে বিবেচিত ও প্রতিষ্ঠিত। এক কথায়, শিক্ষার জগতে তাঁরা শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত। সুশিক্ষিতদের মধ্যে হতে পারে উচ্চশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত কিংবা স্বশিক্ষিত। মানবজাতির ইতিহাসে যাঁরা মহান মানুষ হিসেবে অমর হয়ে আছেন তারা সকলেই ছিলেন সুশিক্ষিত।
এবার নিরক্ষর প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে চাই। প্রশ্ন আসতে পারে নিরক্ষররা আবার শিক্ষিত হয় কীভাবে? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি যে,আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচন করতে গিয়ে মনোনয়নপত্র পূরণ করার সময় প্রার্থীর স্বাক্ষরের ঘরে উল্লেখ আছে- স্বাক্ষর/ টিপসহি। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, জাতীয় সংসদ সদস্যরা সংসদ অধিবেশনে আইন পাস করেন। তাঁরা যদি টিপসই দিয়ে নির্বাচিত হয়ে সংসদে বসার যোগ্যতা রাখেন তাহলে এদেশের নিরক্ষর মানুষদের কেন অশিক্ষিত বা মূর্খ বলে গালি দিই?
এদেশের ঘামঝরা শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অধিকাংশ নিরক্ষর। তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। কিন্তু তাদের পরিশ্রমে দেশ ও জাতি বেশি লাভবান। উদাহরণ হিসেবে যেসব নিরক্ষর পেশাজীবির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে তারা হলেন- কৃষক,তাঁতি, নাপিত, ধোপা, কামার, কুমার ও পরিচ্ছন্নকর্মী। তারা দেখাদেখি কিংবা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে কাজে পারদর্শী সেই কাজটি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। নিজ নিজ পেশায় তাদের যে অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা সেসব কাজ অনায়াসে করতে পারেন। এ কাজে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও প্রশিক্ষণ ব্যতীত করা সম্ভব হয়।
বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে বলা দরকার। যেমন, গ্রামের অনেক মহিলাই জীবনে কোনোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাননি। তাদের বলা যায় নিরক্ষর। কিন্তু তাদের সুস্বাদু রান্না খেয়ে আমরা কত না প্রশংসায় মেতে উঠি। পরিমিত পানি, তেল, লবণ, মরিচ, হলুদ ইত্যাদি সমন্বয়ে তারা নানা রকম তরকারি রান্না করে থাকেন। এই পরিমিতবোধ ও প্রক্রিয়া তারা অর্জন করেন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠাদের কাছ থেকে। এই অভিজ্ঞতায় বিচ্যুতি হলে তাদের হাতের পোলাও-কোর্মাও আহারযোগ্য হয়ে ওঠে না। সুতরাং এটিও এক ধরনের শিক্ষা। এছাড়া আমরা যখন নাপিতের কাছে চুল কাটতে যাই কিংবা মুচির কাছে যাই জুতা সেলাই করতে তখন কিন্তু তাদের প্রশ্ন করি না আপনার এ বিষয়ে ডিপ্লোমা করা আছে কীনা।
আপনার দামি গাড়ি আছে, কিন্তু নিজে চালানোর প্রশিক্ষণ না থাকায় একজন বেতনভুক্ত ড্রাইভার রেখেছেন। তার ওপর আপনিও নির্ভরশীল। অথবা আপনি একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী, কিন্তু বৈদ্যুতিক কাজে অনভিজ্ঞ। আপনার বাড়িতে বৈদ্যুতিক-সমস্যা দেখা দিলে একজন দক্ষ ইলেক্ট্রিশিয়ানের স্মরণাপন্ন হতে হয়। এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই সবজান্তা নন। প্রয়োজনে একজন আরেকজনের কাছে যেতে হয়। কেউ কাউকে ছাড়া জীবন-যাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং কোনা পেশাকে ছোট করে দেখা মোটেও উচিত নয়। এ পৃথিবীতে কেউ কেউ শিক্ষিত নয়, কোনো না কোনো বিষয়ে সকলেই শিক্ষিত।
শাহজাহান আবদালী
কবি, রম্যলেখক ও সংগঠক
প্রকাশিত গ্রন্থ ৭২টি
আপনার মতামত লিখুন : :