• ঢাকা
  • রবিবার, ০৩ আগস্ট, ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.
পর্ব ১: ধরা ছোঁয়ার বাইরে

বাঞ্ছারামপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যান


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | মনিরুজ্জামান পামেন জুলাই ২৭, ২০২৫, ০৭:৪২ পিএম বাঞ্ছারামপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী জাদিদ আল রহমান জনি। বিগত সময়ে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মূর্তমান আতঙ্ক ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের রাজনীতি বা কোন পদপদবীতে না থাকলেও হঠাৎ করেই অল্পবয়সেই বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপর গত কমিটিতে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ১নং সাংগঠনিক সম্পাদকও মনোনীত হন। বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি, উপজেলা প্রশাসন, কমিশন বাণিজ্য, চাকুরি বাণিজ্য থেকে শুরু সবকিছুর একক নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন কাজী জাদিদ আল রহমান জনি ওরফে ভাগিনা জনি। তার কারণেই বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের মনে চরমভাবে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করেছিল। ওই সময় থানা পুলিশের মাধ্যমে দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতন করে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে একেবারে শেষ করে দিয়েছিলেন। তার মাধ্যমেই উপজেলার সমস্ত কমিশন বাণিজ্য ও চাঁদা পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। মামা ক্যাপ্টেন তাজের সমস্ত বিষয়গুলো দেখভাল করতেন ভাগিনা জনি। গত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। তাছাড়া বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মাদক ব্যবসার প্রধান হোতা ছিলেন জনি চেয়ারম্যান। কাজী কমিউনিকেশন লিমিটেড তথা বিকাশের আড়ালে করেছিলেন হুন্ডি ব্যবসা। তিনি ছিলেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলার অঘোষিত এমপি। মামা ক্যাপ্টেন তাজ সাহেবের মাধ্যমে অসংখ্য ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জনি চেয়ারম্যান। তিনি কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করেন। মামা তাজ সাহেবের বদৌলতে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে প্রায় ৪ কোটি টাকা খরচ করে বৌভাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন এই জনি চেয়ারম্যান। অথচ তার বাবা ছিলেন প্রত্যন্ত এলাকার ইউনিয়ন ভূমি অফিসের একজন নায়েব।
জনি পারিবারিক পরিচয়
কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যানের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামের কাজী বাড়িতে। তার বাবার নাম কাজী মোখলেছুর রহমান এবং মায়ের নাম হাছিনা বেগম। তিনি ১৯৮৫ সালের ১ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৪৬৪৮৪৯৭২৫৫। একমাত্র বড়বোন শাম্মি আক্তার স্বামীর সাথে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া বসবাস করছেন। জনি চেয়ারম্যানের স্ত্রী সাদিয়া নওশীন এমি ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ঠিক আগ মুহুর্তে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সহকারি স্থপতি হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ওই পদেই কর্মরত রয়েছেন। বাবার চাকুরির সুবাদে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার উজানচর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার বাবা মোখলেছুর রহমান উজানচর ভূমি অফিসে নায়েব হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জনির উত্থান
২০০৮ সালের পূর্বে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অপরিচিত মুখ ছিলেন কাজী জাদিদ আল রহমান জনি। ওই সময় ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের ছোট বোনের ছেলে হিসেবেই সবাই চিনতো। রাজনীতিতে তার কোন সম্পৃক্ততা ছিল না। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম এমপি হয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১০ সালের দিকে তার উত্থান শুরু হয়। সচিবালয় এবং পরিবহনপুলে মামা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের দপ্তরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর বাণিজ্য শুরু করেন। ২০১১ সালের দিকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হন। তারপর এগিয়ে যেতে থাকেন। ২০১২ সালের ৭ এপ্রিল ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের বড় ভাই আনোয়ারুল ইসলাম আশরাফ চেয়ারম্যানের মৃত্যু হলে রাতারাতি আলোচনায় আসেন কাজী জাদিদ আল রহমান জনি।
রাজনৈতিক পরিচয়
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কিংবা যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না থেকেও মামা ক্যাপ্টেন তাজের ক্ষমতা ব্যবহার করে শুরুতেই ভাগিয়ে নেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের পদ। তারপর বাঞ্ছারামপুর পৌরসভার মেয়র ভিপি তফাজ্জলের মতো নেতাকে ডিঙ্গিয়ে হন উপজেলা আওয়ামী লীগের ১নং সাংগঠনিক সম্পাদক। সেই সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যও হন।
ইউপি চেয়ারম্যান
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা বিএনপির প্রবীন নেতা উজানচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মতিন বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তারপর বেশকিছুদিন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়ারিশ মেম্বার। ওই সময়ই চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হন জনি। পুরোপুরি সাপোর্ট পান মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের। সেই সুবাধে ওই সময় উজানচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা মো. সেলিম মিয়া, তাজুল ইসলাম বড় তাজ মিয়া, তাজুল ইসলাম ছোট তাজ মিয়া, সজিব মিয়া, আক্তার হোসেনের মতো নেতাদের কোনঠাসা করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাছাড়া মামার ক্ষমতাবলে বিএনপি-জামায়াতেরও কাউকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেননি। পরবর্তীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে পুরো ইউনিয়নে লুটপাট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন জনি চেয়ারম্যান। কাজ না করেই সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেন। যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
স্কুলের সভাপতির পদ দখল
বৃহত্তর কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উজানচর কে এন উচ্চ বিদ্যালয়। কৌশলে স্কুলের সভাপতি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের স্ত্রী হাসু ইসলামকে সরিয়ে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন জনি চেয়ারম্যান। তারপর এই প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে কাজ না করেই বিল উত্তোলন করতে থাকেন। একই কাজ একাধিকবার দেখানো হয়। যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তাছাড়া মাধ্যমিক পর্যায়ে যা কিছুই করা হয়েছে সবই উজানচর কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার কারণেই টানা ৭-৮ বছর উপজেলার অন্যান্য মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন জনি চেয়ারম্যান। 
সম্পদের পাহাড়
কাজী জাদিদ আল রহমান জনি চেয়ারম্যানের বাবা মোখলেছুর রহমান আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না। উজানচর ভূমি অফিসে নায়েব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পৈতৃকভাবে কিছু না পেলেও মামা ক্যাপ্টেন তাজের ক্ষমতাবলে নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। রাজধানী ঢাকার গুলশান সার্কেলের ৭-বড় কাঠালদিয়ায় ০.০৮২৫ একর জমি কিনেন, খতিয়ান নং ১৭৮০৫, দাগ নং ৩৬২৬, ৩৬২৭। তাছাড়া গুলশান সার্কেলের ৬-ডুমনীতে ০.২১০০ একর জমি কিনেছেন, খতিয়ান ৯৭৪৫, দাগ নং ১৩৯৭৫। এছাড়াও মতিঝিল সার্কেলের ৯-মান্ডায় ০.০৪১৩ একর জমির মালিকও জনি চেয়ারম্যান, খতিয়ান ১২৫৭০, দাগ নং ৬৫০৪, ৬৫০৫। এখানেই শেষ নয়। রাজধানীর বসুন্ধরায় ৫টি প্লট এবং ৩ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। আফতাবনগরে ২২শত বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে, বনশ্রীতেও ফ্ল্যাট রয়েছে। পুলিশিং হাউজিংয়ে প্লট, জলসিড়িতে প্লট, গাজীপুরেও জমি কিনেছেন, উত্তরায় জমির বায়না করেছেন।
চেয়ারম্যান বাণিজ্য
মামার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এমন কোন কাজ নেই, যা জনি চেয়ারম্যান করেননি। ২০১৪ সালে সর্বপ্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেন তিনি। ওই সময় দুই কোটি টাকা বাণিজ্যের মাধ্যমে চেয়ারম্যান পদে নুরুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান পদে মিন্টু রঞ্জন সাহা, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জলি আমিরকে প্যানেল করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। প্রহসনের ওই নির্বাচনে মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ও জনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় ভোট কেলেংকারির মাধ্যমে বিজয়ীদের পরাজিত করে আলোচনায় এসেছিলেন জনি। তারপর বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় যত নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতেই জনি এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। নেপথ্যে ছিলেন মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টি ইউনিয়নে কোটি কোটি টাকা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দশজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে রেকর্ড গড়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কমপক্ষে ৩০ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি সদস্য এবং ৪২ জনকে ভোট কারচুপির মাধ্যমে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন। প্রশাসনের সহযোগিতায় এবং ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের হস্তক্ষেপে ওই সময় সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিজয়ী করার প্রলোভন দেখিয়ে অনেক পরাজিত প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, ওই টাকা এখনও ফেরত দেননি জনি চেয়ারম্যান। বছরের পর বছর ধরে নির্বাচনে পরাজিত মেম্বার প্রার্থীরা জনি চেয়ারম্যানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। 
হুন্ডি ব্যবসা
বাঞ্ছারামপুরে বিকাশের এজেন্ট ছিলেন রূপসদী গ্রামের শাহনেওয়াজ। পরে মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের সহযোগিতায় নিরীহ শাহনেওয়াজকে হুমকী ধামকী ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিকাশের এজেন্টশীপ দখল করে নেন। তারপর বিকাশের মাধ্যমে শুরু করে হুন্ডি বাণিজ্য। এই হুন্ডির মাধ্যমেই তার বড়বোন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী শাম্মী আক্তারের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতেন তিনি। একসময় জনি চেয়ারম্যানের কাজী কমিউনিকেশন চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে গোয়েন্দাদের তালিকায় শীর্ষ হুন্ডি হিসেবে চিহ্নিত হয়। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ভাগিনা জনি চেয়ারম্যানকে রক্ষা করেন। বিষয়টি দুদক পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বিকাশের দায়িত্ব নামকাওয়াস্তে তারই খালাতো ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 
মাদক ব্যবসা
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মাদকের গডফাদার ছিলেন জনি চেয়ারম্যান। ২০০৮ সালের পূর্বে বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় ২৩টি মাদকের স্পট ছিল। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫টি। এসব মাদকের স্পটগুলো এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর বেশ কয়েকজনকে মাসোহারা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত পুরো উপজেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু জনি চেয়ারম্যানের ভয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। আর সেই কারণে বাধ্য হয়ে ২০১৭ সালে ৬ এপ্রিল বাঞ্ছারামপুর গ্রামের হাশেম মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়াকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয় তারই মা সুরাইয়া বেগম। তৎকালিন উপজেলা চেয়ারম্যান মো. নূরুল ইসলাম, ইউএনও মোহাম্মদ শওকত ওসমান, পৌর মেয়র মো. খলিলুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি র‌্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের একটি দল অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী জগন্নাথপুর গ্রামের দুলাল মিয়ার ছেলে হৃদয় হোসেন ও কামরুল মিয়ার ছেলে জালাল মিয়াকে ১১৫ বোতল ফেনসিডিল ও ২৬ বোতল বিয়ার, মাদক বিক্রির টাকাসহ গ্রেফতার করে। এরা জনির অনুসারি ছিলেন। 
২০১৮ সালের ২২ মে ভোরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে উপজেলার দরিয়াদৌলত ইউনিয়নের মরিচাকান্দি গ্রামের হোসেন মিয়ার ছেলে ধন মিয়া নিহত হয়। ধন মিয়ার নামে বাঞ্ছারামপুর থানায় ৪টি মাদক মামলা ছিল। ধন মিয়া জনির এজেন্ট ছিল। তার আরেক এজেন্ট রূপসদী বাদল ও সবুজ মিয়াকে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রূপসদী গ্রামের দক্ষিণপাড়া থেকে ৩৮৩টি ক্যান বিয়ার ও ১২০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট এবং মাদক বিক্রির নগদ সাড়ে ৭ হাজার টাকাসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব ১৪ এর ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা। 
২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর দরিকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম স্বপনকে খাল্লা গ্রামের বাড়িতে প্রকাশ্যে একাধিক গুলি করে মাদক ব্যবসায়ী বাবু। উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের বাবু একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। ২০১৭ সালের ১৪ মে ৩৫টি ইয়াবা বড়ি, ৬টি গ্যাস লাইট, ১২টি ফুয়েল পেপার, ৪টি বিশেষ পাইপ সহ গ্রেফতার করা হয় ছলিমাবাদ গ্রামের মহরম আলী, মো. রিপন মিয়া ও বাঞ্ছারামপুর গ্রামের মো. নাছির মিয়াকে। ২০২০ সালের ১০ জুলাই রূপসদী গ্রামের কান্দাপাড়ার মরহুম শ্যাম মিয়ার ছেলে মাদক ব্যবসায়ী কালা মিয়া ও তার স্ত্রী ছালমা আক্তারকে ১৫০ গ্রাম গাঁজা ও ২টি বিয়ার ক্যানসহ গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগ রয়েছে এসব মাদক ব্যবসায়ীরা জনিকে ম্যানেজ করেই বছরের পর বছর ধরে মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেছে।
চাকুরি বাণিজ্য
মামার ক্ষমতার বলে বাঞ্ছারামপুরে এককভাবে চাকুরি বাণিজ্য করেছিলেন জনি চেয়ারম্যান। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পিয়ন-ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সরকারি বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। আর এই সুযোগে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যোগ্যদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের চাকরি দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া চাহিদা মতো টাকা না পেলে বিএনপি জামায়াত পরিবারের সন্তান বলে ট্যাগ লাগিয়েও শতশত মেধাবীদের বাদ দেয়া হয়েছে জনির কারণেই।
লুটপাট
ক্ষমতার ১৫ বছরে বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় হরিলুট চালিয়েছিলেন জনি চেয়ারম্যান। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি কোথাও ১ শতাংশ কাজ না করেই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভুয়া ভাউচার তৈরি করে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। একই রাস্তা নামে-বেনামে সংস্কারের কথা বলে একাধিবার প্রকল্প পাস করে বরাদ্দকৃত টাকা তছরুপের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও এলজিএসপি’র ৯ বছরের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ একাধিক ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে। কাজের উন্নয়ন শতভাগ দেখানো হলেও বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। ২০-২১, ২১-২২, ২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর, কাবিখা, এডিপি ও নন ওয়েজ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন দেখিয়ে উত্তোলন করেছে কোটি টাকা। ৪০ দিনের কর্মসূচিতে কোন শ্রমিক না লাগিয়ে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে পুরো এক তৃতীয়াংশ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। যা সঠিক তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
অবৈধ বালি উত্তোলন
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন জনি চেয়ারম্যান। উপজেলার সোনারামপুর, দরিয়াদৌলত ও পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়ন সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে বছরের পর বছর অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করেছেন তিনি। তাছাড়া আইয়ুবপুর ও মানিকপুর ইউনিয়নের কড়িকান্দি-খাসনগর-বাহেরচর সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকেও ড্রেজারের মাধ্যমে বালি উত্তোলন করেছেন। করোনাকালিন সময়ে টানা দেড় বছর বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিতাস ও ঢোলভাঙ্গা নদী থেকেও কোটি কোটি টাকার অবৈধ বালি উত্তোলন করেছিলেন তিনি। অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের কারণে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম আজ ভাঙ্গনের মুখে।  
প্রশাসনে হস্তক্ষেপ
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার অঘোষিত এমপি ছিলেন ভাগিনা জনি চেয়ারম্যান। উপজেলা ইউএনও, এ্যাসিল্যান্ড, থানা পুলিশ, এলজিইডি, প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস থেকে শুরু করে বনবিভাগের অফিস পর্যন্ত তিনি খবরদারি করতেন। তার মানসিক অত্যাচার এবং খারাপ ব্যবহারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা চরমভাবে অতিষ্ঠ ছিলেন। বিশেষ করে উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বেশ বিব্রত হতেন। সত্য মিথ্যা বলে মামা ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলামের মাধ্যমে তাদের অপমান অপদস্ত করতেন, ধমক দিতেন। বলতে গেলে ২০১৪-২০২৪ সাল পর্যন্ত বাঞ্ছারামপুর উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা একধরনের অস্থিরতার মধ্যে চাকরি করেছিলেন। অনেক অফিসার প্রতিবাদ না করে নিরবে সহ্য করে মানসম্মান নিয়ে বাঞ্ছারামপুর থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। একমাত্র জনির কারণেই বাঞ্ছারামপুর উপজেলা এলজিইডি, প্রকল্প বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি অফিস এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলো ঘুষ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। প্রতি মাসে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন জনি চেয়ারম্যান।
রাজনৈতিক নেতাদের অপমান
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের চরমভাবে অপমান অপদস্ত করতেন জনি চেয়ারম্যান। তার কারণেই দলের সিনিয়র নেতাকর্মীরা ছিলেন কোনঠাসা। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথেও চরম র্দুব্যবহার করতেন। আত্মসম্মানের ভয়ে সিনিয়র নেতারা তার কাছ থেকে দূরে থাকতেন।
গ্রেফতার
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর রাতারাতি গা ঢাকা দেন জনি চেয়ারম্যান। পরে ওই বছরের ২৩ আগস্ট দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক হন তিনি। তারপর বাঞ্ছারামপুর উপজেলা ছাত্রদলের নেতা নয়ন হত্যা মামলার আসামী হিসেবে পরেরদিন শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশ নয়ন হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখায়। গোয়েন্দা পুলিশ শুক্রবার বিকেলে জনিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে বিজ্ঞ বিচারক সাদেকুর রহমান তার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারপর আদালতের আদেশে দীর্ঘদিন জেল খেটে ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর জামিনে বেরিয়ে আসেন। একাধিক মামলার আসামী জনি চেয়ারম্যান বর্তমানে তিনি আবারও পলাতক রয়েছেন। তবে একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছে, অবৈধভাবে দখলকৃত জমিজমা বিক্রী করে গোপনে ভারতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। সেখানে থেকে কম্বোডিয়া হয়ে আরব আমিরাত চলে যাবেন। তারপর অস্ট্রেলিয়া চলে যাবেন জনি চেয়ারম্যান। (চলবে . . .)