ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. গোলাম ফারুক। বাঞ্ছারামপুরে যোগদানের পর থেকেই পুরো অফিসটিকে স্বেচ্ছাচারিতা অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন, এমন অভিযোগ উঠেছে। তার খামখেয়ালিপনায় উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটা প্রশ্নের মুখে। সঠিক জবাবদিহিতা না থাকায় দিনের পর দিন তা বেড়েই চলছে। বলতে গেলে সরকারি নিয়মকানুন না মেনে নিজের খেয়াল খুশি মতো তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সপ্তাহের ৭ দিনের মধ্যে ৩ দিন অফিস করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার কর্মস্থল বাঞ্ছারামপুরে হলেও তিনি নরসিংদী থেকে এসে অফিস করেন বলেও জানা গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পরপরই তিনি বাড়িতে চলে যান, তারপর শুক্রবার ও শনিবার বন্ধ। মন চাইলে মাঝে মধ্যে রবিবার দিন আসেন, নয়তো সোমবার। তবে হাজিরা খাতায় নিয়মিতই স্বাক্ষর করেন। তিনি অনেক সময় স্কুল ভিজিটের নাম করেও বাড়িতে চলে যান। এতে করে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে, এমনটাই জানিয়েছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক কর্মকর্তা সহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
অভিযোগ উঠেছে, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুকের গাফিলতির কারণেই উপজেলার বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আয় ব্যয়ের কোন সঠিক হিসেব নেই, নেই জবাবদিহিতা, নেই স্বচ্ছতা, নেই শৃঙ্খলা। গত ১৫ বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হরিলুট হয়েছে। তবে তিনি যোগদানের পর তা আরও বেড়েছে, বিভিন্ন সূত্রে এমনটাই জানা গেছে।
সর্বশেষ বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় শিক্ষা খাতে ৪৫ লাখ টাকার সরকারি অনুদান বেহাত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পারফরম্যান্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউট’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ৭টি মাধ্যমিক ও ২টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুদান পায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) এর আওতাভুক্ত এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইন্সটিটিউট (পিবিজিএসআই) স্কীমের অনুদান হিসেবে দেয়া হয়।
স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদান (এসএমএজি/এমএমএজি/জিবিএজি) হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সারাদেশে ২ হাজার ৫শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। অনুদানের ওই অর্থ সরকারি নিয়মাবলীর ভিত্তিতে খরচ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সাথে পুরো ৫ লাখ টাকা খরচের বিল ভাউচারের ফটোকপি ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ উন্নয়ন ১ শাখায় স্কীমের অফিসে প্রেরণের অনুরোধ জানানো হয়।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্কীমের পরিচালক প্রফেসর চিত্ত রঞ্জন দেবনাথ স্বাক্ষরিত স্মারক: পিবিজিএসআই/এসইডিপি/এসএমএজি/৪৪/২০২৩/৪৪১ থেকে এ তথ্য জানা যায়। সূত্র: ৩৭.০০.০০০০.০৮১.৩৬.০০৪.২০(অংশ).৩৬০। তারিখ ১৩/১২/২০২৩ইং।
স্কীমের অনুদানের অর্থ ৫টি খাতে ব্যয় করার নির্দেশ দেয়া হয়। খাতগুলো হলো ১. শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা ১ লাখ টাকা। ২. বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার সরঞ্জাম ক্রয় এবং লাইব্রেরী উন্নয়নে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ৩. ছাত্র ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য স্কুল/কলেজ/মাদ্রাসার ফ্যাসিলিটি (অবকাঠামো/বিশুদ্ধ পানি/শৌচাগার/কমনরুম/হাইজিন কর্ণার ইত্যাদি) তৈরি, নির্মাণ, সংস্কার উন্নয়নে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৪. সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ১ লাখ টাকা এবং ৫. বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিলিটি উন্নয়নে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই সাথে ৫টি শর্ত দেয়া হয়। যার মধ্যে অন্যতম একখাতের বরাদ্দের টাকা কোনভাবেই অন্যখাতে ব্যয় করা যাবে না। অথচ সরকারি বিধি নিষেধ কোনটাই বাঞ্ছারামপুরে পালন করা হয়নি। এমন অভিযোগ উঠেছে। আর সেজন্য মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুককে দায়ি করছেন সবাই। বলতে গেলে অনিয়মের প্রশ্নে একেবারেই নীরব বাঞ্ছারামপুর মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক।
সরেজমিনে তদন্তে দেখা গেছে, অনুদানের ৪৫ লাখ টাকা অধিকাংশ খাতে অর্থের কোন কার্যকর ব্যবহার হয়নি, বেশিরভাগ কাজই হয়েছে কাগজে কলমে। পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রণোদনার টাকা কিছুটা দেয়া হয়। সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর টাকা হাওয়া হয়ে গেছে বলেও জানা গেছে। বইপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বলতে গেলে এ খাতে পুরো টাকাই লুটপাট হয়ে গেছে। অথচ কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিবিজিএসআই স্কীমের আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাইকল্পে ৫ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সদস্য সচিব উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্যরা হলেন বাঞ্ছারামপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং উপজেলা শিক্ষা প্রকৌশল কর্মকর্তা।
ওই সময় বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বাছাইকৃত ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো শাহ রাহাত আলী হাই স্কুল, ছলিমাবাদ আদর্শ হাই স্কুল, আকানগর এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুল, আশ্রাফবাদ হাই স্কুল, আইয়ুবপুর ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাই স্কুল, পূর্বহাটি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাই স্কুল, বাঞ্ছারামপুর সোবহানিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, তেজখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং ফরদাবাদ আকবর আল উলুম আলীম মাদ্রাসা।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দকৃত ৪৫ লাখ টাকা হরিলুটের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতি বরাদ্দকৃত ৫ লাখ টাকার মধ্যে শিক্ষক প্রণোদনায় ১ লাখ, দরিদ্র শিক্ষা সহায়তা (স্কুল প্রতি ২০ জন) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, লাইব্রেরি ও বইপত্রের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ছাত্রীদের কমনরুম, শৌচাগার ও গবেষণা উপকরণে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী সহায়তায় ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। বাস্তবে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেই বরাদ্দের কোন প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। তবে ফরদাবাদ আকবর আল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষা খাতের টাকা ও অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের টাকা দেয়ার সঠিক তথ্য পাওয়া গেছে। বাকি ৩টি খাতও মোটামুটি স্বচ্ছ ছিল।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দকৃত ৪৫ লাখ টাকা খরচের বিল ভাউচার ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে জমা দেয়ার কথা ছিল। যথা সময়ে স্কীম পরিচালকের দপ্তরে জমা হয়েছে বলে দাবি করেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক। সুবিধা বঞ্চিত ১৮০ জন শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়ার পর তিনি জানান, কয়েকদিন পর তালিকা দিবেন। দীর্ঘদিন পার হওয়ার পরও তিনি তালিকা দেখাতে পারেননি।
নানাবিধ অভিযোগে অভিযুক্ত গোলাম ফারুক সরকারি আইন কানুন, নিয়মনীতিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান। ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর উপ সচিব সাইয়েদ এ জেড মোরশেদ আলী স্বাক্ষরিত ৩৭.০০.০০০০.০৭২.১৮.০০৬.২৪.৩৪২ নং স্মারকে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ওই বিজ্ঞপ্তির বর্ণিত প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের শিক্ষামুখী তথা শ্রেণীকক্ষমুখী রাখার নিমিত্তে বিভিন্ন ধরনের কো কারিকুলাম কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রাখার নিমিত্তে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। যা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ৯টি কর্মসূচির কোনটাই বাঞ্ছারামপুরের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পালন করা হয়নি। বলতে গেলে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুকের গাফিলতিতে এমনটা হচ্ছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক। এখানেই শেষ নয়। গত মে মাসের ২১ তারিখ মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে উপ সচিব মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার স্বাক্ষরিত ৩৭.০০.০০০০.০৭১.০১.০০৯.১৬-১৪৯ নং স্মারকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেমকে উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশে শপথ পাঠ করানোর নির্দেশ দেয়া হয়। যা বাঞ্ছারামপুরে উপেক্ষিত। বলতে গেলে শিক্ষা কর্মকর্তা তা মনিটরিং করেননি। আর সেই সুযোগে বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তা পালন করা হয়নি। শিক্ষার্থীদের অনেকেই নতুন শপথ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানায়। এক্ষেত্রেও তার গাফিলতিকেই দায়ি করছেন উপজেলার সচেতনমহল।
গত ১৭ জুন “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক কর্মচারি ও ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ অনুদান” খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ বিতরণের তালিকা প্রকাশিত হয়। ওই তালিকায় বাঞ্ছারামপুরের কোন শিক্ষক কর্মচারির নাম নেই। অনেকে অনুদানের বিষয়টি জানেন না বলে জানায়। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল বেশ কয়েকজন শিক্ষক কর্মচারি শিক্ষা কর্মকর্তার উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপসদীর সুজন দুলু কলেজ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদিয়া আক্তার, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাঞ্ছারামপুর ডিগ্রী কলেজের শাহরিয়ার হাসান, আকিল আহমেদ এবং সেলিনা আক্তার অনুদান পায়। তাছাড়া নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাঞ্ছারামপুর সরকারি এস এম মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর রিয়াজুল হক এবং ৬ষ্ঠ-অস্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছলিমাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের রাশিদাতুল জান্নাত ও জোবায়েদ রহমান অনুদানের জন্য মনোনীত হন।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মরিচাকান্দি ডিটি একাডেমী ও ধারিয়ারচর হাজী ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে যে, তারা অনুদানের বিষয় সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে সবকিছু মিলে বাঞ্ছারামপুরের শিক্ষার বেহাল অবস্থার জন্য বর্তমান শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুকের দায়িত্বহীনতাকেই অনেকে দায়ি করছেন। তাছাড়া সঠিক তদন্ত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সচেতন মহল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিক্ষা অফিসার, এডিসি (শিক্ষা), কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
আপনার মতামত লিখুন : :