• ঢাকা
  • বুধবার, ২১ মে, ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯শত কোটি টাকার অনিয়ম!


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | নিজস্ব প্রতিবেদক মে ২০, ২০২৫, ১০:৩৬ এএম দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯শত কোটি টাকার অনিয়ম!

দুই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার কোটি টাকা অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে ঢাকার শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিতে ৫০০ কোটি টাকা অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়েছে।
এদিকে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ও বর্তমান ট্রাস্টিদের দখলযুদ্ধে থমকে গেছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের ছয় দাবি তোলার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ বন্ধ ঘোষণা করে পালিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত ভিসিসহ দুর্নীতিবাজ প্রশাসন। প্রতিবাদে গত শুক্রবার সকাল থেকে দিনভর বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিক্ষোভের মুখে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ)।
অন্যদিকে ছাত্রীদের হোস্টেলের সমস্যার সমাধানসহ সাত দফা দাবিতে আল্টিমেটাম দিয়েছেন বেসরকারি বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) শিক্ষার্থীরা। স্থায়ী ক্যাম্পাস, ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে টানা এক সপ্তাহ আন্দোলন করেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে নতুন করে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থী অসন্তোষ চলছে। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের ফাঁদে শিক্ষার্থীরা, বাড়ছে ক্ষোভ। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে। এছাড়া আশ্বাস দিলেও সব দাবি পূরণ করেনি নামি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।  সেখানে নতুন করে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে অনিয়মের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চলছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, বিধি লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে ৩৪৩ কোটি টাকা শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনে স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১০২ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।’
এছাড়া নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারে জড়িত। জানা গেছে, এই সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির চেয়ারম্যানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের তদন্ত করবে দুদক। 
নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম: বেসরকারি নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার নেপথ্যে রয়েছেন দুই জন ট্রাস্টি সদস্য মো. বোরহান উদ্দিন ও মো. লুৎফর রহমানকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটনা। বোরহান উদ্দিন বলেন, ২০১১ সালে তাদেরকে পদত্যাগ করতে চাপ সৃষ্টি করেন আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ। এক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাপ ছিল। প্রাণনাশেরও হুমকি ছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে জীবন বাঁচাতে তারা পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। অথচ প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি ছিলেন তারা।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা ‘বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যসংখ্যা ছিল সাত জন। তারা হলেন ১. মো. আবুবক্কর সিদ্দিক, ২. মো. লুৎফর রহমান, ৩. মো. বোরহান উদ্দিন, ৪. আবু আহমেদ, ৫. মিসেস আয়েশা আকতার, ৬. মো. রেজাউল করিম ৭. প্রফেসর ড. এম শামছুল হক। সাত জন সদস্য সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য ৫ কোটি টাকা এফডিআর প্রদান করেন। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরে আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর সঙ্গে চুক্তি হয় এবং চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল তিনি তাৎক্ষণিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করবেন। বিনিময়ে তিনি বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হবেন। তবে চুক্তির পরই ঋণ পরিশোধ না করে, আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ উদ্যোক্তা সাত সদস্যের মধ্যে ছয় জনের নাম বাদ দিয়ে বহিরাগত আট জন সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করেন এবং নতুন বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠন করেন। এর মাধ্যমে মূলত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করেন। জীবন বাঁচাতে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান পদত্যাগে স্বাক্ষর করেন। গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দুই দিন পরই বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান তাদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দিয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেন বলে অভিযোগ করেন ঐ দুই জন।
এদিকে ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহসহ সদস্যদের অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা পুঁজি করে একটি চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করেছে। তারা বলেন, বোরহান ও লুৎফর মূলত নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে ট্রাস্টি সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সীমাহীন দুর্নীতির দায়ে ২০১১ সালে তারা পদত্যাগ করেন। এ সময় তাদের দুই জনকেই কোটি টাকা দেয় নতুন বোর্ডের সদস্যরা। বোরহান ও লুৎফর নিজ ইচ্ছায় সব কাগজে স্বাক্ষর করেন।
এ ব্যাপারে মো. লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা কোনো হামলা করিনি, কেবল কথা বলতেই গিয়েছিলাম। অথচ আমাদের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, মামলা হয়, জেলেও যেতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় জনপ্রিয়তা অর্জনের পর ৯টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। আমরা কেন পদত্যাগ করতে যাব?’
বন্ধ জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ: ঢাকার অদূরে গাজীপুর মহানগরীর তেলিপাড়া এলাকায় অবস্থিত বেসরকারি জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিষ্ট্রারের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ৬ষ্ঠ জরুরি সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘অনিবার্য কারণবশত’ এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকাল থেকে দিনভর ক্যাম্পাসের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত ভিসি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে পালিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো হলো ১. এক মাসের মধ্যে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যোগ্য উপাচার্য, উপ উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের নিয়োগ সম্পন্ন করা হোক। ২. সব বিভাগে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগসহ শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৩. দ্রুততম সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। ৪. ওয়েবসাইট ও শিক্ষার্থীদের জন্য ই-সেবা পোর্টাল চালু করতে হবে। ৫. সব বিভাগে পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ৬. প্রশাসনিক সেকশনে শিক্ষার্থীরা যেন কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা কোনো প্রকার হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিক্ষোভের মুখে বন্ধ ইউআইইউ: ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ) গত ২৬ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য, সব ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা পদত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ইউআইইউ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। শিক্ষার্থীরা তাদের স্বজনের মৃত্যু, অসুস্থতা, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে না পারলে তাদের ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ পরীক্ষা দিতে অনুমতি পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে জরিমানাসহ বড় অঙ্কের ফি আদায় করা হয়। কর্তৃপক্ষ সব সময় তাদের ওপর নানা অযাচিত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। এদিকে চলমান সংকটের মধ্যেই ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড। গত রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই চিঠিতে অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীদের আগামী ২৬ মের মধ্যে ভর্তি বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে আবেদন করলে শিক্ষার্থীদের চলতি সেমিস্টারে পরিশোধ করা টিউশন ফির সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দেওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

Side banner