ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় শিক্ষা খাতে ৪৫ লাখ টাকার সরকারি অনুদান বেহাত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পারফরম্যান্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউট’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলার ৭টি মাধ্যমিক ও ২টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুদান পায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি) এর আওতাভুক্ত এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইন্সটিটিউট (পিবিজিএসআই) স্কীমের অনুদান হিসেবে দেয়া হয়।
স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদান (এসএমএজি/এমএমএজি/জিবিএজি) হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সারাদেশে ২ হাজার ৫শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান দেয়া হয়। অনুদানের ওই অর্থ সরকারি নিয়মাবলীর ভিত্তিতে খরচ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। একই সাথে পুরো ৫ লাখ টাকা খরচের বিল ভাউচারের ফটোকপি ২০২৪ সালের ৩০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ উন্নয়ন ১ শাখায় স্কীমের অফিসে প্রেরণের অনুরোধ জানানো হয়।
২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্কীমের পরিচালক প্রফেসর চিত্ত রঞ্জন দেবনাথ স্বাক্ষরিত স্মারক: পিবিজিএসআই/এসইডিপি/এসএমএজি/৪৪/২০২৩/৪৪১ থেকে এ তথ্য জানা যায়। সূত্র: ৩৭.০০.০০০০.০৮১.৩৬.০০৪.২০(অংশ).৩৬০। তারিখ ১৩/১২/২০২৩ইং।
স্কীমের অনুদানের অর্থ ৫টি খাতে ব্যয় করার নির্দেশ দেয়া হয়। খাতগুলো হলো ১. শিক্ষকদের জন্য প্রণোদনা ১ লাখ টাকা। ২. বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার সরঞ্জাম ক্রয় এবং লাইব্রেরী উন্নয়নে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ৩. ছাত্র ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য স্কুল/কলেজ/মাদ্রাসার ফ্যাসিলিটি (অবকাঠামো/বিশুদ্ধ পানি/শৌচাগার/কমনরুম/হাইজিন কর্ণার ইত্যাদি) তৈরি, নির্মাণ, সংস্কার উন্নয়নে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ৪. সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ১ লাখ টাকা এবং ৫. বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিলিটি উন্নয়নে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই সাথে ৫টি শর্ত দেয়া হয়। যার মধ্যে অন্যতম একখাতের বরাদ্দের টাকা কোনভাবেই অন্যখাতে ব্যয় করা যাবে না। অথচ সরকারি বিধি নিষেধ কোনটাই বাঞ্ছারামপুরে পালন করা হয়নি। এমন অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে তদন্তে দেখা গেছে, অধিকাংশ খাতে অনুদানের অর্থের কোন কার্যকর ব্যবহার হয়নি, বেশিরভাগ কাজই হয়েছে কাগজে কলমে। দু একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক প্রণোদনার টাকা কিছুটা দেয়া হলেও সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর টাকা হাওয়া হয়ে গেছে বলেও জানা গেছে। বইপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বলতে গেলে এ খাতে পুরো টাকাই লুটপাট হয়ে গেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পিবিজিএসআই স্কীমের আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাইকল্পে ৫ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সদস্য সচিব উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্যরা হলেন বাঞ্ছারামপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি এস এম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং উপজেলা শিক্ষা প্রকৌশল কর্মকর্তা।
ওই সময় বাঞ্ছারামপুর উপজেলার বাছাইকৃত ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো শাহ রাহাত আলী হাই স্কুল, ছলিমাবাদ আদর্শ হাই স্কুল, আকানগর এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুল, আশ্রাফবাদ হাই স্কুল, আইয়ুবপুর ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাই স্কুল, পূর্বহাটি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাই স্কুল, বাঞ্ছারামপুর সোবহানিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, তেজখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং ফরদাবাদ আকবর আল উলুম আলীম মাদ্রাসা।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দকৃত ৪৫ লাখ টাকা হরিলুটের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতি বরাদ্দকৃত ৫ লাখ টাকার মধ্যে শিক্ষক প্রণোদনায় ১ লাখ, দরিদ্র শিক্ষা সহায়তা (স্কুল প্রতি ২০ জন) ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, লাইব্রেরি ও বইপত্রের জন্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ছাত্রীদের কমনরুম, শৌচাগার ও গবেষণা উপকরণে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী সহায়তায় ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। বাস্তবে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেই বরাদ্দের কোন প্রতিফলন পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ছলিমাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি থাকলেও বই অপ্রতুল; নেই ছাত্রীদের কমনরুম বা গবেষণার উপকরণ। আশ্রাফবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুদানের কোন চিহ্ন নেই। আকানগর এসইএসডিপি মডেল হাইস্কুলে কয়েকটি বই দেখা গেলেও নেই লাইব্রেরি, ফার্স্ট এইড বা সাউন্ড সিস্টেম। শাহ রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি ও ল্যাব থাকলেও তা পূর্ব থেকেই স্থাপিত; নতুন করে কিছু হয়নি। আইয়ুবপুর ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই জানেন না এমন অনুদান এসেছে। পূর্বহাটি ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে নেই লাইব্রেরি, নেই মেয়েদের কমনরুম, নেই প্র্যাকটিক্যালের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। তেজখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়, বাঞ্ছারামপুর সোবহানিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও আকবর আল উলুম আলিম মাদ্রাসায়ও একই চিত্র। বলতে গেলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ‘পারফরম্যান্স বেজড গ্রান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউট’ প্রকল্পের টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছে, এমন অভিযোগ করেছেন সচেতন মহল। তবে শিক্ষক ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা টাকা পেয়েছে বলে জানা গেছে। ৫টি খাতের মধ্যে ২টি খাত মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও ৩টি খাত প্রশ্নবিদ্ধ।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করা হলে, ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী’ রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এই তথ্য আমাদের কাছে নেই। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় এ বরাদ্দের অর্থ কোথায় গেল?
অনুদানের বিষয়ে জানার জন্য মোবাইলে পূর্বহাটি ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেনকে ফোন দেয়া হয়। তিনি ফোন ধরেনি।
আকানগর এসইএসডিপি মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন জানান, সুবিধা বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তায় বরাদ্দকৃত ২০ শিক্ষার্থীর নামের তালিকা তার কাছে নেই। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের দপ্তরে তালিকা জমা দেয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি লাইন কেটে দেন।
ফরদাবাদ আকবর আল উলুম আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোখলেছুর রহমান জানান, পিবিজিএসআই স্কীমের পুরো টাকাই সঠিকভাবে ব্যয় হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত ২০ জন শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ৫ হাজার করে টাকা দেয়ার নামের তালিকা তিনি পাঠিয়ে দিবেন বলে জানান।
আশ্রাফবাদ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক জামালউদ্দিন জানান, তার স্কুলে পুরো ৫ লাখ টাকাই সরকারি বিধি মোতাবেক ব্যয় হয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা পাঠিয়ে দিবেন বলে জানান।
আইয়ুবপুর ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওহাব জানান, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। আগামীকাল দুপুরের দিকে সুবিধাবঞ্চিত ৫ হাজার করে টাকা পাওয়া শিক্ষার্থীদের নামে তালিকা পাঠিয়ে দিবেন।
ছলিমাবাদ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, এটাতো আগের ঘটনা। ঠিক আছে, আগামীকাল ২টার পরে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা দিয়ে দেব।
তেজখালী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামাল হোসেন জানান, পিবিজিএসআই স্কীমের পুরোটা টাকাই স্বচ্ছতার সাথে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৫টি খাতে ব্যয় করা হয়েছে।
বাঞ্ছারামপুর সোবহানিয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ও শাহ রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল করিম এর নম্বরে যোগাযোগ করে তাদের পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক শিক্ষক জানান, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। ওই সময় সভাপতি, স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের জনৈক কর্মকর্তার যোগসাজসে টাকা ভাগভাটোয়ারা হয়ে যায়।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দকৃত ৪৫ লাখ টাকা খরচের বিল ভাউচার ২০২৪ সালের ৩০ মার্চের মধ্যে জমা দেয়ার কথা ছিল। যথা সময়ে স্কীম পরিচালকের দপ্তরে জমা হয়েছে বলে দাবি করেন বাঞ্ছারামপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম ফারুক। সুবিধা বঞ্চিত ১৮০ জন শিক্ষার্থীদের তালিকা চাওয়ার পর তিনি জানান, কয়েকদিন পর তালিকা দিবেন। এই মুহুর্তে নতুন স্কীমের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
বাঞ্ছারামপুরের সচেতন অভিভাবকমহল ও এলাকাবাসীর বক্তব্য, সরকারি অর্থের এভাবে অপব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ মানোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। বাঞ্ছারামপুরের এই ঘটনা অনিয়ম-দুর্নীতির একটি বড় উদাহরণ। প্রশাসনের দায়িত্ব এখন দ্রুত তদন্ত করে দায়িদের বিচারের আওতায় আনা, যাতে ভবিষ্যতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ এ ধরনের অনিয়মের সাহস না পায়।
আপনার মতামত লিখুন : :