• ঢাকা
  • রবিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ


বাঞ্ছারামপুর বার্তা | নিজস্ব প্রতিবেদক সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০১:০৫ পিএম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ শেখের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ

আজ ৫ সেপ্টেম্বর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী। এই দিনে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সেই অকুতোভয় বীরকে, যিনি জীবন উৎসর্গ করে রচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ, বীরশ্রেষ্ঠ ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন যশোর জেলার নড়াইল থানাধীন (পরবর্তীতে নড়াইল জেলা) মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে লেখাপড়ার চেয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিকে তার বেশি ঝোঁক ছিল। তবে মাত্র ১৩ বছর বয়সে পিতামাতা উভয়কে হারিয়ে তিনি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন। এরপর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সাংসারিক প্রয়োজনে ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ বছর বয়সে নূর মোহাম্মদ শেখ ইপিআর এ যোগদান করেন।
প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে একই বছর ৩ ডিসেম্বর তিনি দিনাজপুর সেক্টরের কুঠিবাড়ি ক্যাম্পে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। সৈনিক জীবনে তাঁর স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি সকলের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। দিনাজপুর সেক্টরে থাকাকালীন ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে তিনি সাহসিকতা পূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে তাকে ইপিআরের যশোর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বদলি করা হয়। 
২৫ মার্চের গণহত্যার সময় নূর মোহাম্মদ শেখ নিয়মিত ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে বসেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার খবর জানতে পারেন। নিজ মাতৃভূমি ও জাতির এহেন দুর্যোগ পরিস্থিতিতে সকলের সাথে আলোচনা করে নিজের করণীয় ঠিক করতে ছুটি শেষ হওয়ার পূর্বেই তিনি নিজ কর্মস্থল ৪ নং ইপিআর উইংয়ে যোগদান করেন। এসময় ৪ নং উইং ৮ নং সেক্টরের অধীনে যশোর এলাকায় অবস্থান করছিল। ছুটি থেকে কর্মস্থলে যোগ দিয়েই নূর মোহাম্মদ শেখ সহকর্মীদের নিকট হতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার আরও বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারেন। বাঙালি নিধনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডে তাঁর এতদিনের ক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে প্রতিশোধ নেশায় মেতে ওঠে। 
আগস্ট মাসে ৮ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের নির্দেশে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা তাঁর অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ছোটো ছোটো কয়েকটি দলে ভাগ করে দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেন। এরকম একটি দল আগস্ট মাসের শুরুতেই যশোর জেলার চৌগাছা থানার ছুটিপুর নামক একটি গ্রামে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। 
ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বাধীন এই দলেই ছিলেন ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। ছুটিপুর গ্রামটি যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী সদর দপ্তর যশোর ক্যান্টমেন্ট ছিল। তা ছাড়া আগস্টের পূর্বে এই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বহুবার সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রতিবারই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে অনেক লাশ ফেলে রেখে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবুও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছুটিপুর এলাকাটি তাদের দখলে রাখার জন্য বারবার আরও বেশি শক্তি নিয়ে আক্রমণ করে যাচ্ছিল। কারণ সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এই স্থানটি উভয়পক্ষের নিকটই কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সকাল সাড়ে ৯টায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ৪জন সহযোদ্ধাসহ ছুটিপুর প্রতিরক্ষা এলাকার সামনে গোয়ালহাটি গ্রামের কাছে স্ট্যান্ডিং প্যাট্রল ডিউটিতে ছিলেন। তিনি ছিলেন প্যাট্রল অধিনায়ক। শত্রুর উপর দৃষ্টি রাখা ও তাদের আক্রমণের পরিকল্পনা নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাঠানোর নির্দেশ ছিল তাঁর উপর। শত্রুপক্ষ তিন দিক থেকে তাদের আক্রমণাত্মকভাবে ঘিরে ফেলে এবং নূর মোহাম্মদের প্যাট্রলকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুরা বিরামহীন গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং নূর মোহাম্মদের দলের দিকে অগ্রসর হয়। 
শত্রুর প্রচণ্ড গোলাগুলিতে নূর মোহাম্মদ শেখের সহযোদ্ধা সিপাহি নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন। দলের অধিনায়ক হিসাবে নূর মোহাম্মদ শেখ দ্রুত আহত নান্নু মিয়ার দিকে এগিয়ে আসেন এবং নান্নু মিয়ার এলএমজি দিয়ে শত্রুর দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এর ফলে শত্রুর সামনে আসা বাধাগ্রস্ত হয়। এই পর্যায়ে নূর মোহাম্মদ শেখ নিজে এবং তাঁর অধীনস্থ সৈনিকদের বারবার অবস্থান বদল করে শত্রুর দিকে গুলি ছুড়তে নির্দেশ দেন যেন শত্রুপক্ষ তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পারে। 
অবস্থান পরিবর্তনের সময় নূর মোহাম্মদ নিজেই আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে নিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাচ্ছিলেন। এ-সময় তাঁর ডান কাঁধে একটি গুলি লাগে এবং ২ ইঞ্চি মর্টার শেলের আঘাতে ডান হাঁটু ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অপর সহযোদ্ধা সিপাহি মোস্তফা’কে নির্দেশ দেন আহত নান্নু মিয়াসহ সবাইকে নিরাপদ স্থানে ফিরে যেতে।
ইতোমধ্যেই শত্রুপক্ষ তাঁদের আরও কাছাকাছি পৌছে যায়। তখন তাঁদের সামনে দুটো পথই খোলা ছিল। প্রথমটি হল পিছু হটা এবং অন্যটি সরাসরি শত্রুর মোকাবিলা করা। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত নূর মোহাম্মদ ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড রক্তক্ষরণজনিত কারণে অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। সিপাহি মোস্তফা চাচ্ছিলেন তাঁদের দলনেতা নূর মোহাম্মদ শেখসহ সবাই এক সঙ্গে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ফিরে যেতে। মোস্তফা যখন নূর মোহাম্মদ শেখকে ধরে তুলতে চাচ্ছিলেন তখন তিনি পার্শ্ববর্তী একটি গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ধরে থাকেন এবং বলেন- ‘আহত নান্নু মিয়া ও এলএমজিটিসহ তোমরা নিরাপদ স্থানে ফিরে যাও নতুবা আমরা সবাই মারা যাব। সেই সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানটিও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে’। 
দলনেতা ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের এই অনড় সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হন সিপাহি মোস্তফা। তাঁর এসএলআরটি নূর মোহাম্মদের হাতে দিয়ে নান্নু মিয়াসহ বাকি সবাই নিরাপদ স্থানের দিকে এগোতে থাকে। এই পুরোটা সময় নূর মোহাম্মদ তাঁর আঘাতপ্রাপ্ত দেহটাকে টেনে নিয়ে বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে শত্রুদলের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। 
ইতোমধ্যে সহযোদ্ধাগণ নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গিয়েছে দেখে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু মারাত্মক আহত অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। ঘটনাস্থল থেকে গুলিবর্ষণ কমে যেতে দেখে পাকিস্তানিরা অগ্রসর হয় এবং মৃতপ্রায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ’কে একা দেখতে পেয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংগঠিত দল সমন্বিতভাবে তীব্র আক্রমণ করে হানাদার বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করে। ঘটনাস্থলে পৌছে তাঁরা দেখতে পান নূর মোহাম্মদ শেখের নিথর দেহটি পার্শ্ববর্তী ঝোপের আড়ালে পড়ে আছে। চোখ দুটি উপড়ানো এবং পুরো শরীর বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে যশোর জেলার মুক্তাঞ্চল নামে পরিচিত শার্শা থানার কাশিপুর গ্রামে এই বীর যোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে।
বীরত্ব, দেশ ও সহযোদ্ধার প্রতি আবেগ এবং নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধের অনন্য সাধারণ যে উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন তা নিঃসন্দেহে তাঁকে একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে অনন্য করে তুলেছে। 
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ নামটি তাই সকলের মনে চিরন্তন প্রেরণার প্রতীক হয়ে আছে।

Side banner