বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারী এবং বিএমডিসি অনুমোদিত নিবন্ধনপ্রাপ্তরা চিকিৎসা করতে পারবেন। এরমধ্যে বিডিএস ডিগ্রিধারীরা কেবল দাঁতের চিকিৎসা করেন। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। দেশে সনদধারী ডেন্টাল সার্জনদের পাশাপাশি বিএসসি ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট, ডিপ্লোমা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট এবং কোয়াকরা (হাতুড়ে ডাক্তার) হরহামেশাই দাঁতের চিকিৎসা করছেন। আর তেমনই একজন মো. মনির হোসেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডেন্টাল বিভাগের একজন টেকনোলজিস্ট। অথচ বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে দাঁতের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দেন।
বাঞ্ছারামপুর সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন চাকরির সুবাধে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন মনির হোসেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে সময় না দিয়ে উপজেলা সদরে “ঢাকা ডেন্টাল” নামক একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়মিত চেম্বার করে রোগী দেখছেন ও প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। অথচ তিনি চিকিৎসক নন, তিনি শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল টেকনোলজি (ডিএমটি) এবং ব্যাচেলর ইন হেলথ সায়েন্স (বিএইচএস) ডিগ্রিধারী একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এর নিয়মনীতি তোয়াক্কা করে বাঞ্ছারামপুর সরকারি হাসপাতালে কর্মরত হয়েও মনির হোসেন নিজেই রোগী দেখছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন এবং শিশু থেকে বড়দের ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও ঝুঁকিপূর্ণ।
ডেন্টাল টেকনোলজিস্টের দায়িত্ব কী?
সরকারি বিধি অনুযায়ী, একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্টের কাজের পরিধি সীমিত। যেমন: চিকিৎসকের নির্দেশনায় ডেন্টাল যন্ত্রপাতি পরিচালনা, ল্যাব টেস্টে সহায়তা, ডেন্টাল চিকিৎসকদের সহকারী হিসেবে কাজ করা। কিন্তু নিজে রোগ নির্ণয়, ওষুধ লেখা কিংবা চিকিৎসা দেওয়ার অধিকার তাদের নেই। এটি স্পষ্টভাবে কোয়াক আইন লঙ্ঘন এবং মেডিকেল প্র্যাকটিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শিশু রোগীর প্রেসক্রিপশনে বিপজ্জনক ওষুধ!
মনির হোসেনের লেখা একটি প্রেসক্রিপশন থেকে জানা গেছে, সাত বছর বয়সী এক শিশুকে তিনি নিজ উদ্যোগে দিয়েছেন: ঋধসড়শষধা (অসড়ীরপরষষরহ + ঈষধাঁষধহরপ অপরফ): অ্যান্টিবায়োটিক, চৎড়ভবহ: ব্যথানাশক, ঋঁহড়ঃধপ: অ্যান্টিফাংগাল। এ ধরনের ওষুধ নির্ধারণে শিশুর ওজন, সংক্রমণের ধরন, এলার্জি ইতিহাস ইত্যাদি বিবেচনা জরুরি, যা শুধুমাত্র একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকই করতে পারেন। এভাবে চিকিৎসা রোগীর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে।
সরকারি চিকিৎসক অনুপস্থিত, সুযোগ নিচ্ছেন টেকনোলজিস্ট!
স্থানীয় সূত্র জানায়, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটের নিয়মিত চিকিৎসক কর্তব্যে অনুপস্থিত থাকেন, যার সুযোগে মনির হোসেন নিজেই রোগী দেখছেন। এ ছাড়া একটি দালাল চক্র রোগীদের হাসপাতালে না রেখে সরাসরি “ঢাকা ডেন্টাল” ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে করে গরিব রোগীরা চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছে ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সেই কারণে সচেতন মহল তথাকথিত ঢাকা ডেন্টাল ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার রঞ্জন বর্মন বলেন, টেকনোলজিস্ট মনিরের কাগজপত্র আমি দেখেছি। তিনি রোগী দেখতে পারবেন এবং প্রেসক্রিপশনও দিতে পারবেন।
তবে ভিন্ন কথা বলেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. নোমান মিয়া। তিনি বলেছেন, একজন টেকনোলজিস্ট সাধারণত ছোটখাটো বিষয়গুলো দেখভাল করতে পারেন। অফিস ফাঁকি দিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে চেম্বার সাজিয়ে বসতে পারেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদর হাসপাতালে কর্মরত জনৈক স্টাফ জানিয়েছেন, ডাক্তার রঞ্জন বর্মনের সাথে যাদের সুসম্পর্ক রয়েছে, তাদের ব্যাপারে তিনি সবসময়ই পজেটিভ বলে থাকেন। আর সেই কারণেই টেকনোলজিস্ট মনির বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে লোক আসার পরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন ভুয়া ডাক্তার টেকনোলজিস্ট মনির। এতে আমরা লজ্জিত।
এদিকে বিডিএস সনদ আছে কি না বা নম্বর কত এ বিষয়ে জানার জন্য টেকনোলজিস্ট মনিরের নম্বরে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
চিকিৎসক ও আইন বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি ও বিএমডিসি অনুমোদিত নিবন্ধনপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা রোগী দেখা ও প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন। অন্যরা পারেন না। এটি শুধু বেআইনি নয়, বরং জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। কোয়াক চিকিৎসার ফলে ভুল ওষুধ প্রয়োগে মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হতে পারে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ, যার জন্য জেল ও অর্থদণ্ড উভয়ই হতে পারে।
দাঁতের চিকিৎসা করবেন কে?
দেশে কর্মরত ডেন্টাল সার্জনরা বলছেন, ডেন্টাল সার্জন ছাড়া অন্য কেউ দাঁতের চিকিৎসা করলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা প্র্যাকটিস করার অনুমতি চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন। তারা যাতে প্র্যাকটিস করতে না পারেন, সেজন্য আদালতে পাল্টা আপিল করেছেন ডেন্টাল সার্জনরা।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কোষাধ্যক্ষ ও কনজারভেটিভ ডেনটিসট্রি অ্যান্ড অ্যান্ডোডনটিকস বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আলী আসগর মোড়ল বলেন, আম আর আমড়া দুইটা দুই জিনিস। টেকনোলজিস্টরা কখনও দাঁতের ডাক্তার হতে পারেন না। তারা তো চিকিৎসক না। কিভাবে তারা ক্লিনিক চালাবেন? কিভাবে তারা রোগীর ট্রিটমেন্ট করবেন? তারা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ডেন্টাল সার্জনদের সহযোগিতা করার জন্য। তাদের ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট হিসেবেই থাকতে হবে।
টেকনোলজিস্টদের রোগী দেখার ব্যাপারে তিনি বলেন, এখন দেশে যেটা হচ্ছে, তা বিএমডিসি অ্যাক্টের পরিপন্থী। একজন টেকনোলজিস্ট রোগী দেখলে তা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হবে।
ডা. আলী আসগর আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা আদালতে আপিল করেছি। ডেন্টাল সার্জনদের টেকনোলজিস্ট দরকার। তারা আমাদের সহযোগিতা করবেন। তারা চাইলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন। এমনকি তারা পিএইচডি পর্যন্ত করতে পারবেন। কিন্তু একজন ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট কখনও ডেন্টাল সার্জন হতে পারবেন না, বা রোগীর চিকিৎসা করতে পারবেন না। একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করে তারা অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু তাই বলে কখনও চিকিৎসক হতে পারেন না।
রোগী দেখার অনুমোদন দেওয়ার ব্যাপারে বিএমডিসি’র রেজিস্ট্রার ডা. মো. জাহিদুল হক বাসুনিয়া বলেন, আমরা শুধু এমবিবিএস ও বিডিএসদের সার্টিফিকেট দেই ও তাদের রেজিস্ট্রেশন করি। আমরা ছয়টি ডিসিপ্লিনে রেজিস্ট্রেশন করি। কিন্তু এর কোনোটিতেই ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা নেই। আমাদের এখানে রেজিস্ট্রেশন করার কোনও কোয়ালিফিকেশন নেই তাদের। ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট বা কোয়াক যারা চিকিৎসা করছেন, তারা আইনবিরোধী কাজ করছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন ২০১০ এর ধারা ৫ এর ১৯ ও ২০ উপধারায় বলা হয়েছে, যারা নিবন্ধিত চিকিৎসক নয়, তাদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বিএমডিসি।
তিনি আরও বলেন, ডেন্টাল টেকনোলজিস্টরা মূলত টেকনিশিয়ান। তারা ডেন্টাল সার্জনের সহযোগী হয়ে কাজ করবেন। তারা কাজ দেখে দেখে শেখেন, অভিজ্ঞতা হয় বলেই যে লাইসেন্স দেওয়া হবে এটা ঠিক না।
টেকনোলজিস্ট ও কোয়াকদের কাছে চিকিৎসা করানোর কারণে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন দাবি করে ডা. আলী আসগর মোড়ল বলেন, বাংলাদেশে দুই ধরনের চিত্রই দেখা যায়। প্রথমত, রোগীরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করাতে বিদেশ যান। দ্বিতীয়ত, দাঁতের চিকিৎসা করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে রোগীরা এই দেশে আসেন। উচ্চ ও মধ্যম শ্রেণির মানুষ কখনও ডেন্টাল সার্জন ছাড়া দাঁতের চিকিৎসা করান না। কিন্তু অল্প শিক্ষিত মানুষেরা না বুঝে তাদের কাছে সেবা নিতে গিয়ে ঠকছেন।
প্রশাসনের নীরবতা কেন? জরুরি পদক্ষেপ দরকার
এই ধরনের ঘটনা শুধু বাঞ্ছারামপুরেই নয়, দেশের অনেক জায়গায় ঘটছে। বিএমডিসি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন যদি এখনই কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ভুয়া চিকিৎসা কার্যক্রম রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
জনস্বার্থে দ্রুত তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে সচেতন মহল।
আপনার মতামত লিখুন : :