• ঢাকা
  • শনিবার, ০৭ জুন, ২০২৫, ২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
Bancharampur Barta
Bongosoft Ltd.

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ


বাঞ্ছারামপুর বার্তা জুন ৬, ২০২৫, ০৯:৩৪ পিএম জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
প্রিয় দেশবাসী, শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, বয়স্ক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সবাইকে আমার সালাম জানাচ্ছি।
আসসালামু আলাইকুম।
শুরুতেই আপনাদের সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। প্রতি বছরই এই দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় ত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত হয়ে। 
আমরা যদি কোরবানীর মাহাত্ম্যকে ধারণ করে লোভ, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে নিজেদের নিয়োজিত করতে না পারি, তাহলে কোরবানীর ঈদ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আসুন, এ বছর কোরবানিকে সুন্দর, ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত করে গরিববান্ধব করে তুলি।
প্রিয় দেশবাসী,
কোরবানির পশুর চামড়া থেকে অর্জীত আয়ে আমার-আপনার দরিদ্র আত্মীয়পরিজন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও দেশের লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী উপকৃত হয়। আমাদের গরীব স্বজন ও প্রতিবেশিরা তাদের হক যেন ঠিক ঠিক বুঝে পায় সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। তবেই এই উৎসবটি হয়ে উঠবে ধনী গরীব সকলেরই উৎসব।
পশুর চামড়ার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কাজ করছে, একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে। কোরবানির চামড়া সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা, অভিযোগ ও পরামর্শ এই হটলাইনের নম্বরে ফোন করে নেওয়া যাবে। আমরা এবছর কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে ৩০ হাজার টন লবণ বিনামূল্যে সরবরাহ করেছি।
কোরবানির ঈদে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিস্কার পরিচ্ছনতা। আমি দেশবাসীর প্রতি আকূল আহ্বান জানাই আপনারা সকলে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে সমবেতভাবে এগিয়ে আসবেন। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এ বছর যারা পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন তাদের প্রত্যেককে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ মেহেরবাণীতে আপনাদের দোয়ায় এবং সংশ্লিষ্ট সবার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্বের ফলে এ বছর আমাদের হজ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য এসেছে। প্রথমবারের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় ‘লাববায়েক’ অ্যাপের মাধ্যমে হজের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত হজ ব্যবস্থাপনায় কোনো অনিয়মের খবর আসেনি। টাকা দিয়েও হজে যেতে না পারার যন্ত্রণায় কাউকে কাঁদতে হয়নি। হজক্যাম্প কিংবা বিমানবন্দরে কোনো হাজিকে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করতে হয়নি। প্রথমবারের মতো সরকারি টাকায় কাউকে হজে পাঠানো হয়নি।
প্রিয় দেশবাসী,
ঈদ-উল-ফিতরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বাজারের জিনিসপত্রের দাম স্থিতিশীল রাখতে আমরা তৎপর হয়েছি। এবার কোরবানির ঈদেও কোনো জিনিসের দাম যাতে আকস্মিকভাবে বেড়ে না যায় সেদিকে আমরা সর্বোচ্চ নজর দিয়েছি। ফলে এবার আলু, পেঁয়াজ, ডিম, চিনি, শাকসবজি-তরিতরকারি ও মসলাসহ অধিকাংশ পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় কমেছে। আমরা সার্বিক বাজার ব্যবস্থাকে দুর্বৃত্তদের চক্র থেকে বের করে এনে বাজারে একটা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি। জনগণকে নায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিতে সরকারের সবরকমের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
পাশাপাশি, এই কোরবানির ঈদেও দেশবাসী যাতে নির্বিঘ্নে নিজেদের দেশের বাড়িতে যাতায়াত করতে পারেন সেজন্য সরকার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষের জান-মালের নিরাপত্তায় সজাগ রয়েছেন, ঈদের ছুটির মধ্যেও বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। আমি আপনাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
শুধু ঈদের সময় নয়, আগামী দিনে কখনোই বাস, রেল ও বিমানযাত্রায় কোনো ধরনের অনিয়ম যাতে না হয় সেজন্য সরকার একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন টিকেটিং প্ল্যাটফর্ম করতে যাচ্ছে, যেখানে একই প্ল্যাটফর্ম থেকেই যাত্রীরা খুব সহজেই বাস, ট্রেন ও ফ্লাইটের টিকেট ক্রয় করতে পারবেন।
একইরকমভাবে সব ধরনের সরকারি সেবা যাতে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় সেজন্য ‘নাগরিক সেবা বাংলাদেশ’ এই নামে একটি সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। দেশের সর্বত্র-শহরে, হাট-বাজারে তরুণ-তরুণীদের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সার্ভিস সেন্টার স্থাপনের কাজ শুরু করেছি। এটি ঢাকা শহরে কয়েকটি সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে শুরু হয়েছে।
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তারা নাগরিক সেবা কেন্দ্র থেকে সাধারণ নাগরিকদের এনআইডি, পাসপোর্ট, লাইসেন্স, পুলিশের কাছে জিডি করা, কর ফাইলিং করাসহ বিভিন্ন সরকারি ডিজিটাল সেবা দেবেন। এর ফলে দালাল চক্রের খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, নানা রকম হয়রানি ও ভোগান্তি কমবে বলে আমরা আশাবাদী। এই প্রজেক্ট শূন্য বাজেটে আমরা শুরু করেছি। দেশের বিদ্যমান অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করেই সামনে এগিয়ে চলা সম্ভব- এটাই আমরা বাস্তবে করে দেখার চেষ্টা করছি।
আমাদের চেষ্টা হচ্ছে প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে যতগুলো সেবা এর আওতায় আনা যায় সবগুলোকে নিয়ে আসা। আমরা চেষ্টা করছি যাতে শিশু জন্মগ্রহণ করা মাত্রই তার জন্মসনদ পেয়ে যায়। ওটাই হবে তার নাগরিক স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্র কর্তৃক তার দায়িত্ব গ্রহণের অঙ্গীকার। ওখান থেকেই যাবতীয় সকল সনদ সে তার নাগরিক অধিকার হিসেবে ক্রমাগতভাবে সম্মানের সঙ্গে পেতে থাকবে। এক অফিস থেকে আরেক অফিসে তার দৌঁড়াতে হবে না। দালালের পেছনে মাসের পর মাস ঘুরতে হবে না।
বিদেশ সফরে গেলে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায়ই আমাদেরকে সরকারি সেবা পেতে নানারকম দুর্ভোগের কথা জানান। প্রবাসীদের জন্যও বিদেশে তাদের নিজ নিজ শহরে আমরা বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত নাগরিক সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছি। সেখান থেকেই তারা পাসপোর্ট নবায়ন, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করতে পারবেন। 
এগুলি কঠিন কাজ। এগুলোকে কঠিন করা হয়েছে। কিন্তু এখন সরকারের অভ্যন্তরে সাহসী ও উদ্যোগী সিনিয়র সচিব, সচিব এবং ডিজিদের সহযোগিতায় অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে আমরা এটা সমাপ্ত করতে বদ্ধপরিকর।
প্রিয় দেশবাসী,
আপনারা জানেন, ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর এ সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ভয়ংকরভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিও এতটা খারাপ থাকে না, যতটা খারাপ করে দিয়েছে ১৬ বছরের লাগামহীন লুটপাটতন্ত্র।
আশার বিষয় হচ্ছে শুধু ব্যাংক নয়, প্রত্যেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আমানত এখন নিরাপদ। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরে এসেছে। আমাদের অর্থনীতির ইতিবাচক ধারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকেও আকৃষ্ট করছে। 
বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ শূন্যে নেমে যাওয়ার ভয়ে পতিত সরকার বিদেশি ব্যবসায়ীদের আয় নিজ দেশে নিতে দিচ্ছিল না। আমরা সেটা নিরসন করেছি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ইতিবাচক অবস্থায় নিয়ে আসতে পেরেছি।
এ অর্থবছরের আমরা চেষ্টা করেছি এমন একটি বাজেট দিতে যা সত্যিকার অর্থে জনকল্যাণমুখী হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি বাজেট তার আগের বছরের চেয়ে ছোট হয়েছে। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। এই বাজেট প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান নয়, এই বাজেটে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে মানুষকে।
নজরদারি বৃদ্ধির ফলে রপ্তানি আয় বেড়েছে। অর্থনীতির দুঃসময়ে আমাদের প্রবাসী ভাই-বোনেরা রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে এগিয়ে এসেছেন, যার ফলে রেমিটেন্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি জাতির পক্ষ থেকে সকল রেমিটেন্স যোদ্ধাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর অর্থ পাচার রোধে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ছাড়া পুরোনো আমদানি দায় পরিশোধ হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপরও চাপ কমে এসেছে।
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্যে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি একটি বড় কাঠামোগত সংস্কার। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশাল আকারের দুর্নীতি কমবে, রাজস্ব ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়বে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমবে এবং রাজস্ব আহরণের আওতা সম্প্রসারিত হবে।
অর্থনীতিসহ বিগত মাসগুলোতে সরকারের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ছোটবড় বহু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। মোট ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে এক হাজারেরও ওপরে সংস্কার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা যে সংস্কার কমিশন করেছিলাম তাদের সুপারিশের মধ্য থেকে আশু করণীয় সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করে যাচ্ছে। মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কার কমিশন থেকে প্রাপ্ত সুপারিশের ভিত্তিতে ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে ১২৯টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এ সকল সংস্কারকাজের মধ্যে কয়েকটি চুম্বক অংশ আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আইন ও বিচার বিভাগ মোট ৩৩টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইবুনালস) অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধন ও পুর্নগঠন করে আইনটি আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়ন ও জারি করা হয়েছে।
এর অধীনে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ইতিহাসে গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। 
দেওয়ানি কার্যবিধির সংশোধন করা হয়েছে। যার ফলে এখন বাদীকে আর দিনের পর দিন সশরীরে আদালতে যেতে হবে না। একেকটি দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি হতে আগে যত সময় লাগত এই সংশোধনীর ফলে সময়সীমা অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি।
দেশের একহাজারের বেশি অবকাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের নাম পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। তার মধ্যে ছিল সেনানিবাস, বিমানঘাঁটি, নৌ-বাহিনীর জাহাজ, মেগাসেতু, সড়ক, স্থাপনা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, গবেষণাকেন্দ্র- আরও বহু কিছু। এগুলো সব নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রবাসী ভাই-বোনদের অনেকদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়ার অব অ্যার্টনি বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে। এখন পুরোনো পাসপোর্টে ‘নো ভিসা রিকোয়ার্ড স্টিকার’ থাকলে কিংবা জন্মসনদ থাকলে বিদেশ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পাদন করতে পারবে। আগামী দুই মাসের মধ্যে আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তার করা হবে। বছরে এখন গড়ে ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি হয়, আমাদের লক্ষ্য এটিকে ২ লক্ষ মামলায় উন্নীত করা। মামলা দায়েরের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যাদের বিরুদ্ধে মামলার কোনো ভিত্তি নেই তাদের বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি দেশের মানুষকে লুটপাটতন্ত্র থেকে বের করে আনতে। আপনারা জানেন, বিগত ১৬ বছরে উন্নয়নের নামে মেগা প্রকল্প নিয়ে কি পরিমাণ লুটপাট হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো যেন হয়ে উঠেছিল মেগা ডাকাতির প্রকল্প। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প পুনঃরায় মূল্যয়ন করে দেখেছি যে প্রায় সব প্রকল্পেই ভৌতিক ব্যয় ধরা হয়েছে। শুধুমাত্র সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, রেল মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ—এই পাঁচটি বিভাগেই ব্যয় সংকোচ করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা।
এই টাকা দিয়ে জ্বালানি খাতে সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দিয়ে বকেয়ার পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনা হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করে সব ধরনের ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের অগ্রাধিকার।
দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো ও নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে আমাদের গুরুত্ব দিতেই হবে। তা না হলে এদেশকে আমরা যে স্থানে নিয়ে যেতে চাই সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দল ও জনগণ আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন করছেন। সকলের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ, কৌতূহল আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে ৩০টি মূল সংস্কারকাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই ১৮টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং দেশি-বিদেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত অক্টোবর হতে মার্চ পর্যন্ত নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মোট ৭৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫-এ নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক সেশনের মাধ্যমে ব্যবসায়ী চেম্বার, ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের অন্যান্য অংশীদারদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আলোচনার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যাতে করে পরবর্তীতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা যেন বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশ গড়তে নিজেদের প্রতিশ্রুতির কথা জানাতে পারেন। সম্প্রতি চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী চীনের ১০০টি কোম্পানির প্রায় দেড়শ বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। আমরা আশা করছি, খুব দ্রুতই বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ দেখতে পাব।
সম্প্রতি আমি চীন, কাতার, জাপানসহ কয়েকটি দেশ সফর করেছি। এসব সফরেও বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরেছি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আরও বেশি সংখ্যক বাংলাদেশি যাতে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় সে চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশে কাতারের বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের লাখো লাখো ছেলে-মেয়েরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। তাদের জন্য প্রযুক্তি শিক্ষা ও বিদেশি ভাষা শিক্ষা চালু করতে আমরা কাতার চ্যারিটির সাহায্য চেয়েছি।
গত মাসে আমি জাপান সফরে গিয়েছিলাম। এ সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা ও রেলপথ উন্নয়নের জন্য এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ ঘোষণা করেছেন। দ্বিপাক্ষিক তিনটি চুক্তিপত্র বিনিময় হয়েছে। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে।
বাংলাদেশের কর্মশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং জাপানে তাদের কর্মসংস্থান সহজতর করার লক্ষ্যে জাপানের সঙ্গে আমরা দুটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছি। জাপানের শ্রমিক সংকট রয়েছে। আমরা আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লক্ষ কর্মী পাঠানোর চুক্তি সই করেছি। এর চাইতেও আরও বেশি শ্রমিক ক্রমাগতভাবে পাঠানোর আয়োজন করে এসেছি।
প্রিয় দেশবাসী,
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অর্থনৈতিকভাবে আমাদের যে উন্নতির শিখরে থাকার কথা ছিল, বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কথা ছিল সে উচ্চতায় আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা চাই, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। এ কারণে বিনিয়োগ পরিষেবার উন্নয়নের পাশাপাশি বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছি। এটা করা সম্ভব না হলে দেশের কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব ঘুচবে না। অর্থনৈতিক সংকট রয়েই যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। মাঝেমাঝে এমন কথাও শুনেছি যে এ বন্দর বিদেশিদেরকে নাকি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আমি আগেও জানিয়েছি, চট্টগ্রাম বন্দর হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। বর্তমানে এই হৃৎপিণ্ড অতি দুর্বল। এখন যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় তাকে রেখে দিলে আমাদের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। এই হৃদপিণ্ডকে বড় করতে হবে। মজবুত করতে হবে। সুঠাম করতে হবে। তা করতে হলে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অভিজ্ঞদের সাহায্য লাগবে। আমরা যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তারা বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের সেরা, সবচেয়ে অভিজ্ঞ। তারা ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে বন্দর পরিচালনা করে। তাদের কাজ বন্দর ব্যবস্থাপনা করা, আমাদের লক্ষ্য হলো বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ৩১ সালের মধ্যে আমরা বন্দরের কাজ শিখে ফেলি এর পরবর্তী ৫ বছরে অর্থাৎ ৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর এই কোম্পানিগুলো চালায় তাদের বহু বন্দর এই বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে। আপনারা যে বন্দরেই পা দেবেন, দেখবেন সেখানে বাংলাদেশিরা আছেন। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। বহু লোকের ওপরে ওঠার সুযোগ হবে। তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই তারা আমাদের চাকরি দেবে। আগে যেকোনো জাহাজে চড়লে দেখতাম জাহাজের নাবিক চট্টগ্রামের কিংবা সিলেটের। বন্দরের কাজ একবার শিখে নিতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা যে বন্দরে যাব না কেন দেখব সেখানে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট আর বরিশালের লোক। বাংলাদেশের লোক।
আমাদের বন্দর যদি আধুনিক হয়, তা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখবে না, বরং আমরা নেপাল, ভূটানসহ পাশ্ববর্তী সকল দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবো। এই বন্দরই হবে এই অঞ্চলের অর্থনীতির সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।
কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত নানা বন্দরের কর্মচাঞ্চল্যে সমগ্র উপকূল অঞ্চল দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এই পুরো অঞ্চলে অনেকগুলো শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে শুধু সমুদ্রের সান্নিধ্য এবং তার ব্যবহারের দক্ষতার কারণে।
তার সঙ্গে গড়ে উঠবে আরেকটি নতুন শিল্প। আধুনিক পদ্ধতিতে সমুদ্রে মাছ পালন, আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প। এটি আরেকটি নতুন জগত সৃষ্টি করবে। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি এবং তারা উৎসাহ সহকারে সাড়া দিয়েছেন।
বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা যাদেরকে আনছি তারা পৃথিবীর যে-সব দেশে কাজ করে সেসব কোনো দেশেরই সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েনি। আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই আপনারা নিজেদেরকে ভিত্তিহীন বিরোধিতা এবং অপপ্রচারের শিকার হতে দেবেন না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্দর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগে আপনাদের দৃঢ় সমর্থন অব্যাহত রাখুন। যারা বিরোধিতা করছে তাদের প্রতিহত করুন।
আপনারা জানেন, আমাদের দেশে এখন ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। প্রায় ১ লক্ষ রোহিঙ্গা এসেছে ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর সময়কালে, যখন রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। সেখানে চলমান সংঘাত ও মানবিক পরিস্থিতির কারণে এখনো অনেকে আসতে চেষ্টা করছেন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করতে এবং যারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।
আমরা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম, তখন রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে প্রায় মৃত অবস্থায় পেয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক এজেন্ডা থেকে ইস্যুটি ঝরে পড়েছিল। সেই অবস্থা থেকে আমরা ইস্যুটিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টির সম্মুখভাগে নিয়ে আসতে পেরেছি।
আমি গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিলাম। আপনারা জেনে খুশি হবেন, জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এ বিষয়ে একমত হয়েছে এবং তারা একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এই সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হবে।
একইসাথে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক জনমত গঠন করতে পেরেছি। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘের মহাসচিব এনতোনিও গুতেরেজ পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছেন যে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান।
প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরেকটি বড় অগ্রগতি হচ্ছে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক প্রত্যাবাসনযোগ্য রোহিঙ্গাদের সর্বপ্রথম তালিকার ঘোষণা। গত এপ্রিল মাসে ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে আলোচনার সময় মিয়ানমার সরকার প্রথমবারের মতো ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ও আমাদের সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সরকারসহ সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। আমরা যত দেশেই সফর করেছি সব দেশে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় নেতা ও সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাদের সহযোগিতা চেয়েছি। তারাও ইতিবাচকভাবে আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবেলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি রাখাইনের জন্য বাংলাদেশ করিডোর দিয়ে দিয়েছে বলে একটা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি, এটি সর্বৈব মিথ্যা। এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসত্য কল্পকাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম। আপনারা এ বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকবেন। কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হবেন না। এসব অপপ্রচার সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্যচ্যুত হবো না। এই জটিল সমস্যাটি সমাধানে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব। 
প্রিয় দেশবাসী,
আগামী মাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছর পূর্ণ হবে। যাদের আত্মত্যাগের কারণে এই অভ্যুত্থান সম্ভব হলো আমরা তাদেরকে এবং তাদের পরিবারকে প্রতি মুহূর্তে আমাদের দৃষ্টিতে রেখেছি। তাদের জন্য নানা কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়ন করে চলেছি। এখন পর্যন্ত ৮৩৪টি শহীদ পরিবারের মধ্যে ৬৩০টি শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ৬৩ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্রের জন্য ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট যাঁরা আছেন, তাঁদের ওয়ারিশ নির্ধারণ সংক্রান্ত বিষয় নিষ্পত্তি সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্র দেওয়া হবে।
এর পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানে আহত প্রায় সাড়ে ১২ হাজার জনকে ১০৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১৫ হাজার ৩৯৩ জন চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মাধ্যমে ৪০ জন আর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। তাঁদের চিকিৎসা বাবদ এ পর্যন্ত সরকার ৬১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে এবং এই ব্যয় অব্যাহত আছে।
আরও ২৮ জন জুলাই যোদ্ধাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও তুরস্কে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, চীন, মালয়েশিয়া ও নেপাল থেকে ২৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। এই চিকিৎসকবৃন্দ শুধু যাতায়াত খরচ গ্রহণ করেছেন। এর বেশি কিছু তাঁরা গ্রহণ করতে চাননি। আমরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
এ পর্যন্ত শহীদ পরিবারগুলোকে সঞ্চয়পত্র প্রদান, আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও চেক প্রদান বাবদ সরকার মোট ২৮৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি শুরু থেকেই বলেছি, পতিত স্বৈরাচার বাংলাদেশকে যেভাবে ধ্বংসস্তূপ বানিয়েছে সেখান থেকে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হলে ন্যূনতম তিনটি আবশ্যিক কাজ সম্পন্ন করতে হবে:
প্রথমত, বিচার ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দৃশ্যমান করে তোলা।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পুর্নগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার সাধনে প্রয়োজনীয় ঐক্যমত ও পথনকশা তৈরি করা।
তৃতীয়ত, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এ লক্ষ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্থায়ীভাবে সংস্কার করা। 
এই তিনটি ম্যান্ডেট হচ্ছে দেশবাসীর সাথে আমাদের চুক্তি। চব্বিশের শহীদের রক্তেভেজা এই চুক্তি আপনাদের সার্বিক সমর্থন, আস্থা ও সহযোগিতা নিয়ে এবং পতিত শক্তি ও তার দোসরদের সৃষ্ট সকল বাধা-বিপত্তিকে পরাভূত করে আমরা সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবো বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞসহ বিগত ১৬ বছরের গুম-খুন নির্যাতনের সত্য উদঘাটন এবং আর্থিক খাতের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আমরা শুরু করেছি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রসিকিউশন টিম গঠন ও তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের পাশাপাশি বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা প্রক্রিয়াধীন ছিল। যত দ্রুত সম্ভব বিচারকাজ শুরুর ব্যাপারে আমরা আশাবাদী ছিলাম। আপনারা জানেন, জুলাইয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিচার ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিচারকাজ যেন দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয় সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে যত রকম সহযোগিতা প্রয়োজন আমরা তা দিচ্ছি। বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বিচার পর্ব আদালতের অনুমতিক্রমে সরাসরি কিংবা রেকর্ডকৃত পদ্ধতিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এতে করে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। বিচার নিয়ে অপপ্রচার বন্ধ হবে।
প্রসিকিউশন বলছে, বিগত সরকার পতনের পর তাদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। থানা, হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দলিলপত্র পুড়িয়ে বা লুকিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধমূলক স্থাপনার আকার আকৃতি, দেয়াল ইত্যাদি ভেঙে এবং বিকৃত করে প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন ডিজিটাল এভিডেন্স, যেমন ভিডিও, অডিও, ইন্টারনেট ডেটা যেগুলো ডিলিট বা ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো রিকভার এবং রেস্টোর করার কাজ করছেন। এ কাজে আমরা দেশবাসীর কাছেও সহযোগিতা কামনা করছি।
স্বৈরাচারী সরকারের আমলে গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষকে গুম করা হয়েছে। এই মানুষগুলোকে এমনসব বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছিল যাদের কোনো কোনোটির আয়তন ছিল মাত্র তিন ফিট বাই তিন ফিট।
গুমের ঘটনা তদন্ত ও এই ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য একটি স্বাধীন গুম সংক্রান্ত কমিশন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা গুমের এমন এমন রোমহর্ষক ঘটনা আবিষ্কার করেছে যা নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মানুষকে পেট কেটে সিমেন্টের বস্তা ঢুকিয়ে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো, ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে জলন্ত ইট ভাটায় নিক্ষেপ করা হতো, ট্রেন ও গাড়ির নিচে ছুঁড়ে ফেলা হতো। কমিশন এখন পর্যন্ত দুটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা এখনো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিযোগ পাচ্ছে।
ইতোমধ্যে গুমের তদন্ত কার্যক্রমের জন্য ঢাকা শহরের তিনটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় তিনটি গুমের কেন্দ্র পরিদর্শন ও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্তকাজে মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা পর্যায়ে গণশুনানি গ্রহণ করা হয়েছে। মোট আট শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ গণ-শুনানিতে অংশ নিয়েছেন।
গুম সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে জমা হয়েছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।
গত ১৬ বছর ধরে এদেশের প্রতিটি স্তরে অপরাধ, অনিয়ম, দুর্নীতির ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রোগাক্রান্ত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রোগমুক্ত করে জনগণের কল্যাণমুখী করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাদা এবং একত্রিতভাবে বৈঠক করেছি।
সর্বশেষ গত মাসের শেষ সপ্তাহেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমি বৈঠক করেছি এবং চলতি সপ্তাহে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার শুরু করেছি। সরকার পরিচালনায় তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো শুরু থেকে আমাদের সাথে সহযোগিতা করে এসেছে এবং সবসময়ই তারা সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী,
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব ও অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। তারা আমাকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানায়। আমি বলেছিলাম, দেশের সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে সকলে মিলে এ ঘোষণাপত্র দেওয়া ভালো হবে।
এর পাশাপাশি আগামী জুলাই মাসেই সকল রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারবো বলে আশা করছি।
এই জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যেকয়টিতে একমত হয়েছে তার তালিকা থাকবে এই সনদে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে তারা জাতির কাছে সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে।
জুলাই সনদ অনুযায়ী আশুকরণীয় সংস্কার কাজগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাকি অংশের বেশকিছু কাজও আমরা শুরু করে যেতে চাই। আশা করি, অবশিষ্ট অংশ পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের কাছে দেশের নতুন ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তি তুলে ধরা যাবে। বিশ্বব্যাপী সবার কাছে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের শক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।
ঐকমত্য কমিশন গঠন করা আমাদের একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ ছিল। অন্য কোনো দেশে এমন কোনো নজির নেই। এর মাধ্যমে আমরা জাতি হিসেবে রাজনৈতিক গভীরতার সন্ধান পেয়েছি। রাজনৈতিক ঐক্যে পৌঁছার জন্য ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সকল দলের দলগত প্রস্তুতি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কমিশনের সঙ্গে ঐকান্তিক আলোচনা, জাতীয় লাইভ টেলিভিশনের সামনে সকল দলের ঐকমত্যে পৌঁছার একান্ত প্রয়াস আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এই কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে আমি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের সীমাহীন ধৈর্য এবং কমিশনের প্রতি তাদের সহযোগিতা এবং সৌজন্য প্রকাশের জন্য জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করি, আমাদের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করে জাতির জন্য একটা নতুন পথনির্দেশনা রেখে যেতে পারব।
এই কমিশনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশে যে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যদি সেটা বিকাশমানভাবে স্থায়ী রূপ দিতে পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতের সকল রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো।
সকল প্রস্তুতি সমাপ্ত করে দেশের সকল মানুষের- কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-জেলে, গৃহিনী, দিনমজুর, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শিল্পী- সবাই মিলে চেষ্টা করে একটি সুন্দর, নিখুঁত নির্বাচন আয়োজন করে নতুন বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি রচনা করব।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি জানি, আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ রয়েছে। আমি বারবার বলেছি এই নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে। এই সময়ের মধ্যে দেশে নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যা যা করা দরকার, সরকার তাই করছে।
এখানে মনে রাখা জরুরি, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে যতবার গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে তার সবগুলোরই প্রধান কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বারবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল বর্বর ফ্যাসিস্টে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের নির্বাচন যারা আয়োজন করে তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যায়। এমন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দল ক্ষমতায় আসে তারাও জনগণের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো একটি পরিচ্ছন্ন, উৎসবমুখর, শান্তিপূর্ণ, বিপুলভাবে অংশগ্রহণের পরিবেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা যাতে করে দেশ ভবিষ্যতে নতুন সংকটে না পড়ে। এজন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যেই প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সেগুলোতে যদি সুশাসন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে ছাত্র-জনতার সকল আত্মত্যাগ বিফলে যাবে।
সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন এই তিনটি ম্যান্ডেটের ভিত্তিতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সে বিবেচনায় আগামী রোজার ঈদের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে আমরা একটি গ্রহণযোগ্য জায়গায় পৌঁছতে পারবো বলে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার- যা কি না জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়- সে বিষয়ে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারব।
এতে আমাদের ওপর আপনাদের অর্পিত ম্যান্ডেট ন্যূনতম হলেও বাস্তবায়ন করে যেতে পারব। সে বিবেচনায় ও ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য সকল পক্ষের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। পাশাপাশি, বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।
আমরা এমন নির্বাচন চাই যা দেখে অভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আমরা চাই আগামী নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটার, সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ও দল অংশ নিক। এটা সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে জাতির কাছে স্মরনীয় থাকুক। 
দেড়যুগ পরে দেশে সত্যিকারের একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হবে। বিপুল তরুণ গোষ্ঠী এবার জীবনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এসব লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তাঁরা অনুমোদন করেন।
আপনারা ওয়াদা আদায় করে নেবেন যে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার প্রশ্নে কখনো কোনো প্রকার আপোষ করবেন না এবং দেশের বাইরের কোনো শক্তির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না।
আপনারা তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেবেন এই মর্মে যে তাঁরা কখনোই, কোনো অবস্থাতেই আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করবেন না।
আপনারা তাদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন যে তারা সম্পূর্ণ সততা ও স্বচ্ছতার সাথে দেশ পরিচালনা করবেন এবং সকল প্রকার দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি গণবিরোধী কাজ থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত রাখবেন।
আমি আপনাদের আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এবারের নির্বাচন শুধু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয় নয়। এটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচন। এই নির্বাচনে পরিচিত দলগুলিই থাকবে। তাদের পরিচিত মার্কাগুলিই থাকবে। কিন্তু ভোটারকে বের করে আনতে হবে যে এই মার্কার পেছনে আপনার কাছে ভোটপ্রার্থীরা কে কতটুকু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার জন্য প্রস্তুত। কে কতটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আমরা যারা এই নির্বাচনে ভোটার হবো তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান এবং সৌভাগ্যবতী। আমরা একটা অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের সুযোগ ও দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা জাতির নতুন যাত্রাপথ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব পাচ্ছি। আমরা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি সৃষ্টির মহান সুযোগটা পাচ্ছি। আমাদের সুচিন্তিত ভোটের মাধ্যমেই নতুন বাংলাদেশ নির্মিত হবে। শহীদদের রক্তদান সার্থক হবে। আশা করি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেই সবাই ভোটকেন্দ্রে যাবো এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে ভোট দেবো। এখন থেকে ভাবনা চিন্তা শুরু করুন। আলোচনা শুরু করুন। এখন থেকে আপনাদের ভোটের গুরুত্বটা বুঝে নিন। আপনার এবারের ভোটের গুরুত্ব ঐতিহাসিক মানদন্ডে দেখা হবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা নতুন বাংলাদেশ গড়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নানামুখি অপপ্রচারে লিপ্ত। তারা সবসময় চাইবে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জাতীয় ঐক্যের শক্তিকে পরাভূত করতে, গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টাকে লাইনচ্যুত করতে এবং বাংলাদেশকে পুনরায় করায়ত্ব করতে।
আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আমরা একটা যুদ্ধাবস্থায় আছি। এখন আমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে যেকোনো মূল্যে। পরাজিত শক্তি এবং তাদের সহযোগীরা ওত পেতে বসে আছে আমাদের ছোবল মারার জন্য, আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়ার জন্য। আমরা তাদের কিছুতেই এই সুযোগ দেব না।
আসুন, আমরা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও জাতীয় মর্যাদার বিরুদ্ধে যেকোনো আঘাত প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রতিরোধের ঐক্যবদ্ধ সুদৃঢ় প্রাচীর গড়ে তুলি।
প্রিয় দেশবাসী,
সবাইকে আবার ঈদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানাচ্ছি।
মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
আল্লাহ হাফেজ। 

Side banner