বাংলাদেশের লোকসংগীত অঙ্গনে এমন কিছু শিল্পী জন্মেছেন, যারা তাদের কণ্ঠ, সুর এবং সাধনার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ এবং হৃদয়ে তুলেছেন স্থায়ী আসন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন কিংবদন্তি বংশীবাদক ও কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী। একাধারে তিনি ছিলেন একজন উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী, বাউল গায়ক, গবেষক ও বাঁশির সাধক। তার কণ্ঠে যেমন ছিল বিষাদের কান্না, তেমনি ছিল আধ্যাত্মিক প্রশান্তি। এ প্রতিবেদনে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো।
জন্ম ও শৈশব
বারী সিদ্দিকীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলায়। সংগীতের প্রতি আকর্ষণ ছিল পারিবারিক ও ব্যক্তিগত উভয়ভাবেই। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি বাঁশির প্রতি অনুরাগ অনুভব করেন এবং গানের তালিম নিতে শুরু করেন মায়ের অনুপ্রেরণায়। সংগীতচর্চার এই আগ্রহ তার পুরো জীবনকে ঘিরে ধরে।
শিক্ষাজীবন ও সংগীত প্রশিক্ষণ
বারী সিদ্দিকী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেন নেত্রকোনা সরকারি কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সংগীত শিক্ষায় তিনি গুরু হিসেবে পেয়েছেন পণ্ডিত গোপাল দত্ত, ওস্তাদ আমিনুর রহমান এবং ভারতীয় বাঁশিবাদক পণ্ডিত ভিজি কার্নাডকে। পুনে শহরে থাকাকালীন সময়ে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। তার সংগীতচর্চা ছিল কেবল শখ নয়, বরং সাধনা।
সংগীত জীবনের উত্থান
প্রথমবার তিনি টেলিভিশনের পর্দায় আসেন ১৯৯৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত “রঙের বাড়ি” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তবে জাতীয়ভাবে পরিচিতি পান ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ গাওয়া “শুয়া চান পাখি” গানের মাধ্যমে। এই গান রাতারাতি তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয় এবং তিনি হয়ে ওঠেন গ্রামীণ লোকসংগীতের এক উজ্জ্বল প্রতিভা।
জনপ্রিয় গান ও অ্যালবাম
বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো “শুয়া চান পাখি”, “আমার গায়ে যত দুঃখ সয়”, “মানুষ ধরো মানুষ ভজো”, “পুবালি বাতাসে”, “তুমি থাকো কোন ছায়ায়” ইত্যাদি।
তার বেশ কয়েকটি অ্যালবামও শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেঁথে নেয়, যেমন লোকোখো তারা, মাটির দেহ, মাটির মালিকানা, মন বেড়ো জ্বালা প্রভৃতি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচরণ
বারী সিদ্দিকী কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও তার সুরের যাদু ছড়িয়ে দেন। ১৯৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ডড়ৎষফ ঋষঁঃব ঈড়হভবৎবহপব-এ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পী ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, ইরান, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশন করেছেন।
ব্যক্তিগত জীবন
বারী সিদ্দিকীর স্ত্রী ফারিদা এহসান। তাদের ঘরে দুই পুত্র (সব্বির, বিলাশ) ও এক কন্যা (এ্যালমা) রয়েছে। তার মেয়ে এ্যালমা নিজেও সংগীতচর্চার সঙ্গে যুক্ত, বিশেষ করে বাউল ধারায়। বারী সিদ্দিকী নেত্রকোনায় ‘বাউল বাড়ি’ নামে একটি সংগীত গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলেন যেখানে তিনি লোকসঙ্গীত নিয়ে গবেষণা ও প্রশিক্ষণের পরিবেশ তৈরি করেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। জানাজা শেষে তাকে তার জন্মভূমি বারহাট্টায় দাফন করা হয়।
বারী সিদ্দিকী ছিলেন এক অনন্য সাধক, যার গানে মিশে ছিল বাউল দর্শন, আধ্যাত্মিক চেতনা, লোকজ সংস্কৃতি ও আত্মিক বিষাদ। তার বাঁশির সুর ছিল এমনই যে, একবার শুনলে সেই সুর শ্রোতার হৃদয়ে রয়ে যেত চিরকাল। আজও তার গান বাংলার গ্রামে-গঞ্জে, শহরের অলিতে-গলিতে বাজে যেন এক ব্যথাতুর আত্মার ভাষ্য। বারী সিদ্দিকী ছিলেন, আছেন, থাকবেন বাংলার গানে ও প্রাণে।
আপনার মতামত লিখুন : :