ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ইউনিয়ন হলো সোনারামপুর। ২০১৬ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত এই ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. শাহিন মিয়া। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গা ঢাকা দেন পরপর দুইবার নির্বাচিত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মো. শাহিন মিয়া। তাছাড়া একাধিক মামলায় জর্জরিত হয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর এই সুযোগে পুরো ইউনিয়ন পরিষদ দখলে নেন ইউপি সচিব মোজাহিদুল্লাহ ইসলাম পারভেজ। বলতে গেলে পুরো পরিষদকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছেন তিনি। আর সেই কারণে এলাকাবাসী তার বদলী দাবি করছে।
ইউপি সচিব মোজাহিদুল্লাহ পারভেজ সোনারামপুরে যোগদানের পরপরই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে। অতিরিক্ত টাকা ছাড়া তিনি কোন কাজ করেন না। সেবা প্রত্যাশীদের সাথে দুর্ব্যবহার তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে। তিনি নিয়মিত অফিস করেন না, চৌকিদারদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। কেউ প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দেখান। সবকিছু মিলে সোনারামপুর ইউনিয়ন পরিষদকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন ইউপি সচিব পারভেজ।
বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ২য় বৃহৎ ইউনিয়ন হলো সোনারামপুর। বর্তমানে এই ইউনিয়নের আয়তন ৫,২৪৭ একর বা ২১.২৩ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সোনারামপুর ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা ২৬,৯৩০ জন। কৃষি ও মৎস প্রধান অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সোনারামপুর ইউনিয়ন ৮টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এই ইউনিয়নে দেশবরেণ্য অগণিত কৃতি সন্তানের জন্ম হয়েছে। বলতে গেলে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার অপার সম্ভাবনাময় ইউনিয়ন সোনারামপুর। শুধুমাত্র ইউপি সচিব মোজাহিদুল্লার স্বেচ্ছাচারিতা ও গাফিলতির কারণে থুবড়ে পড়েছে এখানকার সেবাকার্যক্রম।
গত ৫ বছরে সোনারামপুর ইউনিয়নে কত টাকা ট্যাক্স উঠানো হয়েছে, এই ট্যাক্সের টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে, টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে কি না, ব্যাংকের নাম কি, শাখা কোথায়, ইউনিয়নের ট্যাক্স প্রদানকারীদের নামের তালিকা সংরক্ষিত আছে কি না, ট্যাক্সের টাকাগুলো ক্যাশ বইতে উঠানো হয়েছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি ইউপি সচিব মোজাহিদুল্লাহ ইসলাম পারভেজ।
এই ইউনিয়নের কানাইনগর, চর মরিচাকান্দি, শান্তিপুর, ইছাপুর, দুলারামপুর, ফেরাজিয়াকান্দি, সোনারামপুর ও চর শিবপুর গ্রামের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কোন তথ্যও নেই। অভিযোগ রয়েছে ইউনিয়নের মিসেস হাসু ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়, ৮টি সরকারি ও ৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭টি কবরস্থান, ১০টি ঈদগাহ, ৫২টি মসজিদ, বেশকিছু মাদ্রাসা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের নামে গত ৮ বছরে কাগজে কলমে উন্নয়নের কথা থাকলেও বাস্তবে অনেকটাই লুটপাট হয়ে গেছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, মাতৃত্বকালীন, ভিজিডি সহ নানাখাতে অনিয়ম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়েও অভিযোগের শেষ নেই। জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যু সনদ নিয়ে আর্থিক কেলেংকারি লোকমুখে প্রচারিত। আর এসব কিছুর জন্য ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সচিব পারভেজকেই অনেকে দায়ি করছেন।
বর্তমানে সোনারামপুর ইউনিয়ন পরিষদে সদস্য তথা মেম্বার হিসেব রয়েছেন শাহেনা বেগম, হনুফা বেগম, জুলেখা বেগম, শামীম আহম্মেদ, মো. ইসমাইল, মো. হেলাল উদ্দিন, জামাল মিয়া, কালন হোসেন, মনির মিয়া, মো. মিজান ভূঁইয়া, দুলাল মিয়া ও ফরিদ মিয়া। নানা কারণেই এদের অনেকে ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে পারে না।
বিগত সময়ে সোনারামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন মো. সুরুজ মিয়া ১৯৫৯-১৯৬৪, বজলুর রহমান ১৯৬৪-১৯৭২, সোলেমান আহাম্মদ ১৯৭২-১৯৭৩, হাজী লোকমান মিয়া ১৯৭৩-১৯৭৫, আব্দুল লতিফ, কেরামত আলি ১৯৭৬-১৯৮৪, সরকার শহিদ আহাম্মদ ১৯৮৪-১৯৯১, এরশাদুর রহমান ১৯৯২-১৯৯৮, জাহাঙ্গীর আলম সরকার ১৯৯৮-২০০৩, মোহাম্মদ কামরুল হাসান হারুন ২০০৩-২০১১, জসিম উদ্দিন ভুঁইয়া জালু মাস্টার ২০১১-২০১৬ পর্যন্ত। ২০১৬ থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. শাহিন মিয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনারামপুর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্যদের একজন জানান, ইউপি সচিব পারভেজ ঘুষ ছাড়া কোন কাজই করেন না। তাছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শাহিন চেয়ারম্যান গা ঢাকা দেয়ায় ইউপি সচিব বেপরোয়া হয়ে গেছে। তিনি ট্যাক্সের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তদন্ত করলে সবই বেরিয়ে আসবে।
জনৈক চৌকিদার জানান, স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে পরিচিত ইউপি সচিবের বাড়িতে গেলে এবং তার ব্যাপারে তদন্ত করলেই দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসবে। শাহিন চেয়ারম্যান না থাকায় ইউপি সচিব পারভেজ পুরো ইউনিয়নকে নানাভাবে গিলে খাচ্ছে।
এদিকে ইউপি সচিব পারভেজের নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে জানার জন্য শাহিন চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করলে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ পরিচালক (উপ সচিব) শঙ্কর কুমার বিশ্বাসের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন : :